মুফতি সাআদ আহমাদ
দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দুর। সূর্য যেন আজ আগুনের মূর্তি ধারণ করেছে। মরুভূমির বালুরাশির ওপর চলছে তার অবিরাম অগ্নিবর্ষণ। চোখ তুলে তাকাতে গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। হাঁটতে গেলে পায়ে ফোসকা উঠবে। এমন দিনে বাইরে বের হওয়া মানে নির্ঘাৎ মৃত্যু। কিন্তু তাই বলে জীবন তো বসে থাকে না। প্রয়োজন তো আর সময়ের দোহাই মানে না।
গায়ে ভারী কোর্তা আর পায়ে চামড়ার মোজা পরিহিত এক পথিক। অনেক কষ্টে নিজের শরীরটা বয়ে নিয়ে পথ এগোচ্ছে। চেহারাজুড়ে চরম ক্লান্তির ছাপ। পিপাসায় আকণ্ঠ শুকিয়ে আসছে তার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সামনে চলছে। হয়তো কোথাও পানির সন্ধান মিলবে।
ওই তো একটি কূপ দেখা যায়। মুহূর্তেই সারা শরীরে একরাশ খুশির জোয়ার বয়ে গেল। চোখে-মুখে ফিরে এলো এক অভিনব চাঞ্চল্য। মনের অজান্তেই ছুটে গেল কুয়ার কিনারায়।
কিন্তু একি? পানি তো অনেক গভীরে। কোনো বালতি-দড়িও তো দেখা যাচ্ছে না। অগত্যা কুয়ায় নামার বিকল্প নেই। হাত ও পায়ের সাহায্যে নিচে নামতে শুরু করল। জীবন বাঁচাতে হলে এতটুকু তার করতে হবে।
কুয়ার অতলে স্বচ্ছ ঝকঝকে পানি। পথিকের আর দেরি সইছে না। দুই হাতের কোশ দিয়ে তুলে একের পর এক ঢোক গিলে যাচ্ছে। প্রতি ঢোক পানি যেন একেকটি নতুন জীবন। যথাসম্ভব পেট ভরে পানি খেয়ে নিতে হবে তাকে। কারণ সামনে যে তার অনেক দীর্ঘ সফর।
পথিক এখন বেশ তৃপ্ত। চেহারার ক্লান্তির অবসাদ অনেকটা কেটে গেছে। শরীরজুড়ে অন্য রকম সজীবতা অনুভব হচ্ছে তার। ধীরে ধীরে কূপ থেকে উঠে আসতে লাগল ওপরের দিকে। আলহামদুলিল্লাহ—আল্লাহর শুকরিয়া।
কিন্তু ওপরে উঠে একটি দৃশ্য দেখে তার চেহারা মলিন হয়ে যায়। বড়ই মর্মান্তিক চিত্র। একটি কুকুর পিপাসার তাড়নায় কুয়ার পাড়ের ভেজা মাটি চেটে চেটে খাচ্ছে। শক্ত পাথুরে মাটির ঘর্ষণে জিভটা তার ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রচণ্ড গরম ক্লান্ত করে ছেড়েছে ওর সারা শরীর। দোল খাচ্ছে সামনে-পেছনে। শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। হয়তো আর কিছুক্ষণ বাদেই ঢোলে পড়বে মৃত্যুর কোলে।
মাটির দিকে চেয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ পড়ল নিজের মোজা জোড়ার দিকে। চামড়ার মোজা। এতে করে পানি তুলে আনা যাবে নিশ্চয়ই। একটানে পা থেকে মোজা দুটি খুলে নিল। দ্রুত কুয়ার নিচে ছুটল পানির সন্ধানে। একটি জীবন বাঁচানোর প্রত্যয়ে।
কুয়ার প্রাচীর হিঁচড়ে দ্রুত নিচের দিকে নামতে লাগল পথিক।
মোজাভর্তি পানি। কিন্তু বাদ সাধল অন্য কিছু। মোজাভর্তি পানি হাতে ধরে ওপরে উঠবে কিভাবে? নিরুপায় হয়ে পায়ের মোজা মুখেই নিতে হবে। দাত দিয়ে কামড়ে ধরল কর্দমাক্ত মোজা। আর হাত-পায়ের সাহায্যে বেয়ে উঠল ওপরের দিকে।
অল্প অল্প করে পানি ঢেলে দিচ্ছে পথিক। জিব বের করে পথিকের দান সাদরে গ্রহণ করছে কুকুরটি। লেজ নেড়ে অভিবাদন জানাতে কসুর করেনি মোটেও। মোজার সবটুকু পানি সাবাড় হয়ে গেল নিমেষেই। কুকুরটিকে দেখে এখন বেশ সতেজ মনে হচ্ছে। একটু আগে কেমন ছটফট করছিল তৃষ্ণায়। কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে সেদিনের মতো পথিকের কাছ থেকে বিদায় নিল। একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি খাওয়াতে পেরে নিজেও খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে পথিক। আলহামদুলিল্লাহ। সব কর্তৃত্ব মহান আল্লাহর।
নবীজি (সা.)-এর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সাহাবিরা সবাই। খুব বিস্ময়ের সঙ্গে ঘটনাটি শুনছিলেন তাঁরা। একটি প্রাণীর জন্য এতটা উদার হতে পারে কেউ? সত্যিই তুমি মহান হে পথিক? নবীজি বলেন, মহান আল্লাহর কাছে পথিকের এই কাজ এত পছন্দ হলো যে আল্লাহ তাআলা পথিকের সব গুনাহ মাফ করে দিলেন।
উপস্থিত এক সাহাবি কৌতূহলবশত জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসুল! চতুষ্পদ জীবজন্তুর মধ্যেও কি আমাদের জন্য নেকি উপার্জনের ক্ষেত্র রয়েছে? নবীজি বলেন, হ্যাঁ, প্রত্যেক তপ্ত কলিজা সিক্ত করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান রয়েছে। (বুখারি, হাদিস : ৬৬২৬)
লেখক : শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম রশিদিয়া
ফুলবাড়ী গেট, খুলনা।