জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ এক গর্বিত অংশীদার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানটি ধরে রাখা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর মজ্জা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে ডিআর কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের সব সংঘাতপূর্ণ এলাকার জনমনে শ্রদ্ধার স্থান করে নিয়েছেন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। একসময় যেসব দেশের সাধারণ মানুষ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত ছিল না, সেসব দেশে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে অতি প্রিয় একটি দেশ।
বাঙালি ও বাংলা ভাষার পরিচিতি বেড়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্য পেছনে ফেলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্বমানবতার সেবায়। পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিক আচরণের কারণে তাঁরা আজ ওই সব দেশের মানুষের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন।
শান্তি রক্ষা মিশনে অবদান রাখা দেশগুলোর অবস্থান সম্পর্কে জাতিসংঘের ‘ডিপার্টমেন্ট অব পিসকিপিং অপারেশন্স’ প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ সেনা প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে রুয়ান্ডা দ্বিতীয়, ইথিওপিয়া তৃতীয়, নেপাল চতুর্থ, ভারত পঞ্চম এবং পাকিস্তান ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছিল।
২০২০ সালের আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে তার শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখে। এর আগের মাসগুলো এবং অন্যান্য বছরেও বাংলাদেশ কখনো প্রথম আবার কখনো দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিন পর্যন্ত ২৮ মাসের মধ্যে ২০ মাসই বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল।
মিশনে বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছয়জন ফোর্স কমান্ডার ও সাতজন ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনেরও গৌরব অর্জন করেন।
নভেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বের আটটি সংকটাপন্ন দেশে এবং জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মোট ছয় হাজার ৭৩০ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এঁদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৬৫০ জন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই সংখ্যা বর্তমানেও প্রায় অপরিবর্তিত।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আইএসপিআর জানায়, সেনাবাহিনীর পাঁচ হাজার ২৮১ জন সদস্য শান্তি রক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ ক্ষেত্রে রোল মডেল স্বীকৃত। আড়াই যুগের বেশি সময় ধরে বিশ্বের ৪০টি দেশের ৫৪টি মিশনে শান্তি রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রেখে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা দেশের গৌরব বাড়িয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক অবদান রেখেছেন তাঁরা।
ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজে গত মে মাস পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে ১৫৩ জনকে। আহত হয়েছেন ২২৯ জন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য ২১৯ জন। নিহতদের তালিকায় রয়েছেন সেনাবাহিনীর ১২২ জন, নৌবাহিনীর চারজন, বিমানবাহিনীর পাঁচজন এবং পুলিশের ২২ জন।
আইএসপিআরের সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, ১৯৮৯ সালে ইরাক-ইরানে সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে ১৫ জন বাংলাদেশির দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ শুরু হয়। এরপর গত আড়াই যুগে প্রায় এক লাখ ৭১ হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিভিন্ন দেশে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এই মিশনে দায়িত্ব পালন করে আসছে ১৯৯৩ সাল থেকে। বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা এই মিশনে অংশ নিচ্ছেন ১৯৮৯ সাল থেকে। দেশের প্রায় দুই হাজার নারী শান্তিরক্ষী এরই মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন সম্পন্ন করেছেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণও ক্রমে বাড়ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ২৭০ জন নারী জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর ৫১ জন নারী কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পদবির সৈনিক ৬৭ জন, নৌবাহিনীর ছয়জন নারী কর্মকর্তা এবং বিমানবাহিনীর ১১ জন নারী কর্মকর্তা। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম ২০১০ সালে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে পুলিশের নারী দল পাঠায়।
বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে যে ছয়জন জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন তার মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে আমাদের অংশ নেওয়ার কারণে বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলা ভাষা অনেক দেশে পরিচিত হয়েছে এবং মর্যাদা পেয়েছে। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত না হতো তাহলে এই কৃতিত্ব অর্জন সম্ভব হতো না। পাকিস্তান নামের একটি রাষ্ট্রে এটি বাঙালিদের নিজস্ব পরিচয়ের বাইরে সীমিত অংশগ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যেত।’
তিনি আরো বলেন, ‘শান্তি রক্ষা মিশনে সাফল্যের মূলে রয়েছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর শৃঙ্খলা, দক্ষতা, দায়িত্ববোধ, মানবিক আচরণ ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধৈর্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে শান্তি রক্ষার এই সাফল্য কাজে লাগাতে আমাদের পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি।’