মিয়ানমার নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে চলা গুঞ্জনই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে অং সান সু চির দল এনএলডির ভূমিধস জয় সামরিক বাহিনীর মনঃপূত হয়নি। ২০১৪ সালে সংশোধিত ডিফেন্স সার্ভিসেস অ্যাক্ট অনুযায়ী, বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় আগামী জুলাই মাসেই অবসরে যেতে হবে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে। সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সু চির কথিত বেসামরিক পুতুল সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক বেশ আগেই তিক্ত হয়ে উঠেছিল।
সিনিয়র জেনারেল মিনের উত্তরসূরিরা সেই সম্পর্ক মেরামত করবেন—এমন আশাও করেছিলেন অনেকে, কিন্তু সিনিয়র জেনারেল ও তাঁর সামরিক প্রভাববলয়ের সমর্থকরা তা চাননি। দৃশ্যত তিনি চাচ্ছেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে। সু চির দল গত নভেম্বরে জিতে যাওয়ায় সেই আশা পূরণে বাদ সাধে।
গত কয়েক দিনে কোনো তথ্য-প্রমাণ দেওয়া ছাড়াই নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের নানা অভিযোগ তুলতে থাকে সামরিক বাহিনী। সেগুলো তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় পার্লামেন্টের অধিবেশন বসার কয়েক ঘণ্টা আগে গতকাল সোমবার সকালে স্টেট কাউন্সেলর নোবেলজয়ী অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করেছে সামরিক বাহিনী।
বিবিসি জানায়, সু চির সরকারের সময় তৃতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সাবেক সামরিক জেনারেল মিয়ন্ত সোয়েকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দিয়েছে মিয়ানমার বাহিনী। তবে সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা নিয়েছেন। নভেম্বর মাসের নির্বাচনের ফলাফল সামরিক বাহিনী প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, জরুরি অবস্থা জারি শেষে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দলের কাছে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২০১১ সালের পর আবারও মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল সামরিক বাহিনী।
রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলে কিছু মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ করলেও আপামর জনসাধারণের মনে উদ্বেগ, ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে। সু চির দল এনএলডি তাদের ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে সেনা অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমারে ১৯৬২ থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে সামরিক শাসন ছিল। এখন আবারও সেই অবস্থায় ফিরল। গত কয়েক বছরে সু চির তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার আসলে গণতান্ত্রিক ছিল না।
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকারকর্মী মং জার্নি গত রবিবার রাত থেকেই মিয়ানমার পরিস্থিতির খোঁজ রাখছিলেন। টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, সু চির নেতৃত্বে তথাকথিত ‘ভঙ্গুর গণতন্ত্রের’ নামে মিয়ানমারে যে মিথ্যাচার চলছিল, তার অবসান ঘটেছে। মিয়ানমার বাহিনী যখন রোহিঙ্গা জেনোসাইড চালিয়েছে, তখন সেখানে গণতন্ত্রায়ণের মিথ্যা আশা দেখিয়েছিলেন সু চি। সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই বিরাট মিথ্যা ধ্বংস হয়েছে।
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসন ছিল না উল্লেখ করে মং জার্নি আরো লিখেছেন, ‘ট্রাম্প ও তাঁর লাখ লাখ সমর্থক ভোট চুরির গল্প সাজিয়েছিল। তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক দেশ। অন্যদিকে বার্মিজ জেনারেল ও তাঁদের প্রক্সি দলগুলো এক কোটি পাঁচ লাখ ভুয়া ভোটের অজুহাত তুলে অং সান সু চিকে বন্দি করেছে। তারা পার্লামেন্ট বাতিল করতে পারে। মিয়ানমার স্বপ্নেও গণতান্ত্রিক দেশ নয়।’
বিশ্লেষকরা মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানালেও স্বীকার করেছেন, সংবিধানেই জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা দেওয়া আছে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ককে। জাতীয় নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার অজুহাতে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। ওই সংবিধান মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীই রচনা করেছিল।
মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের সাবেক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি মিয়ানমার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে ওই দেশের সামরিক বাহিনীর ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দপ্তর হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি গতকাল সকালে এক বিবৃতিতে বলেছেন, মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল না মানলে বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে পিছু হটলে এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিসহ নেতাদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আইনের শাসন অবশ্যই সমুন্নত রাখতে হবে।
এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে, মিয়ানমার পরিস্থিতি তারা আমলে নিয়েছে। চীন আশা করে, সব পক্ষ স্থিতিশীলতা বজায় রেখে ও সংবিধানের মধ্যে থেকেই মতপার্থক্য নিরসন করবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মিয়ানমারে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার পাশাপাশি শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে বাংলাদেশ আশা করে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার হুমকি বেশ আগে থেকেই ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তা জোরালো হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো আলাদাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। আগামী কয়েক দিনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আচরণ কেমন থাকে তার ভিত্তিতে এটি ঠিক করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমার পরিস্থিতি বাইডেন প্রশাসনের নজরে আছে। সু চিকে মিয়ানমারে গণতন্ত্রায়ণের পথে আশার আলো হিসেবে দেখা হয়। এ কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি বড় ধরনের প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে।
জানা গেছে, গত সপ্তাহে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করে বিবৃতি দেওয়ার পর সামরিক বাহিনী আরো ক্ষুব্ধ হয়। তা ছাড়া রোহিঙ্গা জেনোসাইড, গণহত্যাসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) চলমান উদ্যোগ নিয়েও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষুব্ধ। আইসিজে গত বছর জানুয়ারি মাসে এক অন্তর্বর্তী আদেশে মিয়ানমারকে জেনোসাইড ঠেকাতে অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছেন। মিয়ানমার সেই আদেশ পালন করছে কি না, তা পর্যালোচনার জন্য আইসিজে কয়েক মাস আগে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। মিয়ানমার ও এর সামরিক বাহিনী আইসিজে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কড়া নজরদারির মধ্যে আছে। অন্যদিকে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলির দপ্তর রোহিঙ্গা জেনোসাইডের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর শীর্ষ জেনারেলরা দেখতে পাচ্ছেন তাঁদের সামনে বড় বিপদ আসছে। বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ গত দুই বছরে মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে তাঁদের চলাচলের গণ্ডিও ছোট হয়ে আসছে।
অং সান সু চির নিজে আইসিজেতে মিয়ানমারের পক্ষে দাঁড়ালেও অন্তর্বর্তী আদেশ ঠেকাতে পারেননি। তা ছাড়া রোহিঙ্গা নিপীড়নসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ক্রমেই আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছিল মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর। সু চির সরকার তা ঠেকাতে পারছিল না বলেও সামরিক মহলে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছিল। এই সুযোগে সামরিক বাহিনী আবারও ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। এতে সর্বত্র সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।