গরমকালের তুলনায় শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের হার বাড়ে ৩১ শতাংশ। বিশেষ করে তাপমাত্রা যখন ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে, তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে সেই ঝুঁকি চার গুণ বেড়ে যায়। শীতে হার্ট অ্যাটাক রোধে করণীয় বিষয়ে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান
হার্ট অ্যাটাকের সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত হলো অ্যাকিউট চেস্ট পেইন। তবে হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ স্ত্রী ও পুরুষভেদে পরিবর্তিত হতে পারে। বেশির ভাগ সুস্থ মানুষ শীতের সময় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন। তবে যাঁদের করোনারি আর্টারিতে কোলেস্টেরল বা ফ্যাট জমার প্রবণতা থাকে, তাঁদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায় এই সময়।
ঝুঁকি বেশি যাঁদের
♦ আগে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এমন ব্যক্তি।
♦ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগী।
♦ ধূমপায়ী।
♦ যাঁরা বসে বসে কাজ করেন বেশি অথবা কায়িক পরিশ্রম করেন না।
কারণ
হার্ট অ্যাটাকের ক্ষেত্রে কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণ দায়ী নয়। এ ক্ষেত্রে বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, জেনেটিক কারণ, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল ইত্যাদি বিষয় দায়ী হতে পারে। তবে শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের জন্য কিছু কারণকে দায়ী করা হয়। যেমন :
রক্তনালি সংকুচিত হওয়া
শীতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দেহের রক্তনালিগুলো আগের তুলনায় কিছুটা সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে ধমনিতে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এতে কাঁপুনি আসা, মেটাবলিক রেট বেড়ে যাওয়া, এমনকি হার্ট অ্যাটাকের সমস্যাও হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরলসহ একাধিক সমস্যাও এই আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।
হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনের ঘাটতি
দেহের তাপমাত্রা কমার সঙ্গে সঙ্গে হৃদযন্ত্রে অক্সিজেনের চাহিদা ও রক্তসংবহনেও পরিবর্তন আসে। তাপমাত্রা হঠাৎ করে কমলে রক্তনালির রক্তপ্রবাহ সংকুচিত হয়, ফলে হৃৎপিণ্ডে চাপ পড়ে। তখন হৃৎপিণ্ডে বেশি পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। আর অতিরিক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে হৃৎপিণ্ডকে জোরে জোরে পাম্প করতে হয়। এতেই হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বাড়ে।
শরীরচর্চা বা কায়িক শ্রমের ঘাটতি
এই সময় ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে শরীরচর্চা বা কায়িক শ্রমও কম হয়। এতে রক্তনালিতে রক্ত চলাচল কম হয়। এর প্রভাবেও বেড়ে যায় হৃদরোগের আশঙ্কা।
হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
শীতকালে হৃত্স্পন্দন বেড়ে যায়। ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। বেশি পরিশ্রম হয় হৃৎপিণ্ডের। ফলে রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
শীতকালে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে করণীয়
কিছু সতর্কতা মেনে চললে শীতকালে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে বলে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে আগাম সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে যা করা উচিত তা হলো :
♦ যাঁদের হৃদযন্ত্র দুর্বল, ভোরের ঠাণ্ডা বা কুয়াশা এড়িয়ে চলতে হবে তাঁদের। নিয়মিত হালকা শরীরচর্চা করতে হবে।
♦ ঠাণ্ডা লাগাবেন না মোটেই। গরম সুতি কাপড় পরে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন। প্রয়োজনে মাথা ও কান ঢাকা টুপি, হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করুন, মোজা পরুন।
♦ গোসলের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করুন। ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ করে বাথরুমে গিয়ে মাথায় ঠাণ্ডা পানি ঢালবেন না। একটু রয়েসয়ে পানি ঢালুন। বেশি ঠাণ্ডা মনে হলে পানি হালকা ফুটিয়ে নিন। আবার যাঁরা গরম পানিতে গোসল করতে পছন্দ করেন, তাঁরা বাথরুমে গিয়ে প্রথমে পায়ে পানি ঢালুন। এরপর শরীরের উপরিভাগে পানি ঢালুন।
♦ ঘুম থেকে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়াবেন না। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন। এরপর ধীরে ধীরে উঠে প্রথমে ৩০ সেকেন্ড বিছানায় বসে তারপর নামুন। এতে শরীরে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হবে। দ্রুত উঠলে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে বা অক্সিজেনের ব্যাঘাত ঘটে অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। শরীরে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হলেই বিছানা থেকে নামা উচিত।
♦ বয়স্কদের ঘরে একা একা রাখবেন না, বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময়। সম্ভব হলে সঙ্গে কাউকে রাখুন।
♦ নিয়মিত সুগার, রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের মাত্রা মাপুন। চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ চালিয়ে যান।
♦ যাঁদের বংশগত হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা রয়েছে, তাঁদের নিয়মিত চেকআপ করানো খুব জরুরি।
♦ ওজন বেশি থাকলে কমিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
♦ বুক ব্যথা, বমি বমি ভাব, এমনকি ঝিমুনি ভাব এলেও সতর্ক হোন।
যা খাবেন
♦ হার্ট ভালো রাখতে স্বাস্থ্যকর ডায়েট মেনে চলুন। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার, টাটকা শাক-সবজি, ফলমূল, বাদাম বেশি খেতে পারেন।
♦ সব সময় গরম খাবার খান। খেতে পারেন গরম স্যুপ।
যা খাবেন না
♦ শীতকালে খুব বেশি পানি পান করা নয়।
♦ অতিরিক্ত লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
♦ তৈলাক্ত, ভাজাপোড়া খাবার, ফাস্ট ফুড, জাংক ফুড একেবারে নয়।
♦ ঠাণ্ডা বা ফ্রিজে রাখা সরাসরি খাওয়া পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন।
♦ হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অনেকাংশে বাড়ায় ধূমপান। ফলে হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। বেড়ে যায় হৃত্স্পন্দন ও রক্তচাপ। তাই ধূমপান একেবারেই নয়।
একান্তই হার্ট অ্যাটাক হলে
সতর্ক হওয়ার পরও একান্তই কারোর নিজের বা অন্য কারোর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু নিয়ম মানলে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। যেমন :
নিজের ক্ষেত্রে করণীয়
♦ হার্ট অ্যাটাক হলে ভয় পাবেন না।
♦ হার্ট অ্যাটাকের ১০ সেকেন্ডের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সে ক্ষেত্রে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে খুব দ্রুত জোরে ও ঘন ঘন কাশি দিন, কাশির সঙ্গে কফও বের করার চেষ্টা করুন।
♦ প্রতিবার কাশি দেওয়ার আগে দীর্ঘশ্বাস নিন। এভাবে ঘন ঘন কাশি ও দীর্ঘশ্বাস প্রতি দুই মিনিট পর পর করতে থাকুন। এতে আপনার হার্ট কিছুটা হলেও নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করবে।
অন্য কেউ আক্রান্ত হলে
♦ রোগীর মাথা ৩০-৪৫ ডিগ্রি উঁচু করে শুইয়ে রাখুন, যাতে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সুবিধা হয়।
♦ আক্রান্তকে ঝিমিয়ে পড়তে দেবেন না; বরং তাঁর সঙ্গে কথা বলতে থাকুন।
♦ রোগীকে শুইয়ে দুই হাতের তালু পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ (ইন্টারলক) করে কার্ডিয়াক পালমোনারি রিসালিটেশন (সিপিআর) পদ্ধতিতে পুরো শরীরের ভর দিয়ে ঠিক বুকের মাঝখানে পাম্প করুন। মুখে মুখে দম দিন ও নিন। এভাবে ১৬-১৮ সেকেন্ডের মধ্যে ৩০ বার পাম্প করুন।
♦ রোগীর নাক বন্ধ করে থুতনি উঁচু করে ধরুন। ফের বুকে পাম্প করুন। পুরো সাইকেলটা কমপক্ষে পাঁচবার করুন।
♦ এসব করতে করতে রোগীকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিন।
চিকিৎসা
♦ কেউ যদি বুঝতে পারেন যে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে, তখন বিলম্ব না করে অ্যাসপিরিন ৩০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট সরাসরি চিবিয়ে খেয়ে ফেলুন। অ্যাসপিরিন হার্ট অ্যাটাকে ৩০ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমাতে পারে। অন্যান্য অসুখ থাকলেও এটা সেবনে কোনো ক্ষতি নেই। এটা ফার্মেসিতে পাওয়া যায়, দামও কম।
♦ নাইট্রেট স্প্রে বা ট্যাবলেট জিবের নিচে দিতে পারেন। এরপর গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট খেয়ে একটা ইসিজি করে হার্ট অ্যাটাকের মার্কার হিসেবে রক্তের ট্রপোনিন পরীক্ষা করে দেখুন।