প্রাথমিক রাউন্ড থেকে অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে টি২০ বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্বে উন্নীত হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। তবে প্রথম ম্যাচেই এশীয় প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হওয়ায় শুরুটা জয় দিয়ে করার স্বপ্ন দেখেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদরা। কিন্তু সেটি বাস্তব করতে পারেননি তারা। শারজাতে রবিবার হওয়া ম্যাচে ৫ উইকেটে হেরেছে বাংলাদেশ। অথচ এই ম্যাচটিকে ঘিরে শারজা ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সকাল থেকেই বিপুল পরিমাণ দর্শক বাংলাদেশকে সমর্থন দিতে এসেছিলেন। বাংলাদেশী সমর্থকদের মধ্যে ছিল সাজসাজ রব। তাদের বিমর্ষ চিত্তেই পরাজয়ের গ্লানিতে মাঠ ছাড়তে হয়েছে। শারজার ছোট মাঠে আগে ব্যাট করে মুশফিকুর রহিম ও নাইম শেখের জোড়া অর্ধশতকে ৪ উইকেটে ১৭১ রান তোলে বাংলাদেশ।
কিন্তু ইনিংসে মাত্র ২ ছক্কা হাঁকানোর পর এই ইনিংসটাকে বড় মনে হয়নি। সেটিই সত্য করেছেন চারিথ আসালঙ্কা ও ভানুকা রাজাপাকসে- দু’জনই অর্ধশতক হাঁকিয়ে অপরাজিত থেকেছেন এবং ৮ ছক্কা হাঁকিয়েছেন। তাই ৭ বল হাতে রেখে (১৮.৫ ওভার) ৫ উইকেটে ১৭২ রান তুলে সহজ জয় ছিনিয়ে নেয় লঙ্কানরা। তাদের শুরুটা দারুণ হলেও বিশ্বকাপে আবারও মূল পর্বে (প্রাথমিক রাউন্ডের পর) হার দিয়ে শুরু করল বাংলাদেশ।
একাদশে দুই পেসার নিয়ে তাসকিন আহমেদের পরিবর্তে বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদকে নেয় বাংলাদেশ। মাঠটা ছোট, তবু টস জিতে আগে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় লঙ্কানরা। ফর্মের তুঙ্গে থাকা অফস্পিনার মাহিশ থিকশানা ইনজুরিতে ছিটকে যাওয়ায় বিনুরা ফার্নান্দো সুযোগ পান। ব্যাটিংয়ে নেমে এদিন বাংলাদেশকে দুর্দান্ত শুরু দেন লিটন দাস ও নাইম। ঘটনাবহুল পাওয়ার প্লে’র প্রথম ২ ওভারে আসে মাত্র ৯ রান। দুশমন্ত চামিরার করা তৃতীয় ওভারে ১২ রান উঠলে পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে ১ উইকেটে ৪১ রান পায় বাংলাদেশ। ষষ্ঠ ওভারের পঞ্চম বলে উত্তেজনা তৈরি হয় যখন লিটনকে সাজঘরে ফিরিয়ে লাহিরু কুমারা বিরূপ মন্তব্য করেন। লিটনও তর্কে লিপ্ত হন এবং দু’জনের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিও হয়। শ্রীলঙ্কার অন্যান্য খেলোয়াড় ও আম্পায়াররা এসে বিষয়টির সমাধান করেন। ২০১৮ সালে নিধাহাস ট্রফিতে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়। তারপর আর টি২০ ক্রিকেটে দেখা হয়নি দু’দলের। সাড়ে ৩ বছর পর এই ফরমেটে আবার সাক্ষাতের দিনেই পুরনো সেই উত্তেজনা ফিরে আসে। তবে ম্যাচের বাকি সময়ে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি আর দেখা যায়নি। লিটন ১৬ বলে ২ চারে ১৬ রান করেন। ৪০ রানের উদ্বোধনী জুটি ভেঙ্গে যায়। দারুণ এই শুরুর পর অবশ্য সাকিব (৭ বলে ২ চারে ১০) বোল্ড হয়ে যান চামিকা করুনারতেœর স্লোয়ারে টাইমিংয়ে গড়বড় করে। এরপরও ১০ ওভারে ২ উইকেটে ৭২ রান তুলে বড় সংগ্রহের ভিত পেয়ে যায় বাংলাদেশ।
নাইমের সঙ্গে দুর্দান্ত এক জুটি গড়ে তোলেন ফর্মহীনতায় ভোগা মুশফিক। তৃতীয় উইকেটে তারা ৭৩ রান যোগ করেন মাত্র ৫১ বল থেকে। চলতি বিশ্বকাপে নিজের দ্বিতীয় অর্ধশতক তুলে নেন সাবধানী নাইম ৪৪ বলে। এর পর কিছুটা আক্রমণাত্মক হতে শুরু করেন তিনি। তবে ৫২ বলে ৬ চারে ৬২ রান করার পর বিনুরার পেসে ক্যাচ দেন। শেষ ৩ ওভারে বাংলাদেশকে বড় একটি সংগ্রহে নিয়ে যান মুশফিক। সর্বশেষ ৭ টি২০ ম্যাচে মাত্র ৬২ রান করা এ অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ব্যর্থতা কাটিয়ে ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ টি২০ অর্ধশতক তুলে নেন মাত্র ৩২ বলে। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ৩৭ বলে ৫ চার, ২ ছক্কায় ৫৭ রানে। শেষ ৫ ওভারে ২ উইকেটে ৫৩ রান আসে মুশফিকের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে। ৪ উইকেটে ১৭১ রান তোলে বাংলাদেশ। কুমারা দারুণ বোলিংয়ে ৪ ওভারে ২৯ রান দিয়ে নেন ১ উইকেট। জবাব দিতে নামা শ্রীলঙ্কাকে প্রথম ওভারেই ধাক্কা দেন নাসুম। ইনিংসের চতুর্থ ওভারে কুসাল পেরেরাকে (১) বোল্ড করে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই উইকেট পেয়ে যান। তবে এরপর ঝড় তোলেন আসালঙ্কা। নাসুম তৃতীয় ওভারে ১৬, শেখ মেহেদি ষষ্ঠ ওভারে ১৫ রান দেন। আসালঙ্কার বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে ১ উইকেটে ৫৪ রান তোলে শ্রীলঙ্কা। সপ্তম ওভারে প্রথম বল হাতে নিয়ে মুস্তাফিজুর রহমানও ১৩ রান দেন। ৮ ওভারে ১ উইকেটে ৭১ রান তুলে ক্রমেই বাংলাদেশের জন্য শঙ্কা তৈরি করে লঙ্কানরা।
পঞ্চম ওভারে ৫ রান দেয়া সাকিব নবম ওভারে ফিরে দারুণ ব্রেক থ্রু দেন বাংলাদেশকে। প্রথম বলে পাথুম নিশঙ্কাকে এবং চতুর্থ বলে আভিস্কা ফার্নান্দোকে (০) বোল্ড করে জোড়া আঘাতে লঙ্কানদের কাঁপিয়ে তোলেন তিনি। শহীদ আফ্রিদির বিশ্বকাপে সর্বাধিক (৩৯) উইকেট শিকারের রেকর্ডকে পেছনে ফেলেন। এখন সাকিবের টি২০ বিশ্বকাপে শিকার ৪১ উইকেট। নিশঙ্কা ২১ বলে ১ চার, ১ ছয়ে ২৪ রান করেছিলেন। ৪৫ বলে ৬৯ রানের জুটি ভেঙ্গে যায়। হাসারাঙ্গাও আগে ব্যাট করতে এসে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের শিকার হয়েছেন মাত্র ৬ রানে। ১০ ওভারে ৪ উইকেটে ৮০ রান তুলে অবশ্য এগিয়েই থাকে লঙ্কানরা। সেখান থেকে বাংলাদেশ দলকে একাই হারিয়ে দিয়েছেন আসালঙ্কা।
লিটন সহজ দু’টি ক্যাচ হাতছাড়া করেন এবং তাতে ম্যাচও বাংলাদেশের হাত ফসকে গেছে। আসালঙ্কা ৩৭ বলে ৬৩ রানে মুস্তাফিজের বলে এবং আফিফের বলে রাজাপাকসে ১১ বলে ১৪ রানে সহজ ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান। এ দু’জনই পরবর্তীতে তুলোধুনো করেছেন সব বাংলাদেশী বোলারদের এবং উপহার দিয়েছেন গ্লানির হার। তবে লিটন দুই ক্যাচ ছাড়লেও ১২ ওভারে ৪ উইকেটে ৯০ রান তোলা লঙ্কানদের বিপক্ষে সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু এলোমেলো বোলিংয়ে আফিফ ১৩তম ওভারে ১৫, মাহমুদুল্লাহ ১৪তম ওভারে ১৬, সাইফউদ্দিন ১৬তম ওভারে ২২ ও সাকিব ১৭তম ওভারে ১১ রান দিলে সব আশাই শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের। রাজাপাকসে মাত্র ২৮ বলে ফিফটি হাঁকিয়ে শেষ পর্যন্ত ৩১ বলে ৩ চার, ৩ ছক্কায় ৫৩ রানে নাসুমের বলে বোল্ড হন। ফলে আসালঙ্কা ও তার ৫২ বলে ৮৬ রানের বিস্ফোরক পঞ্চম উইকেট জুটি ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ৩২ বলে ফিফটি হাঁকিয়ে শেষ পর্যন্ত ৪৯ বলে ৫ চার, ৫ ছক্কায় ৮০ রানে অপরাজিত থেকে দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন আসালঙ্কা। একমাত্র সাকিব কিছুটা সমীহ আদায় করে ৩ ওভারে ১৭ রানে ২ উইকেট নিয়েছেন।