আতাউর রহমান খসরু
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। দুর্নীতির কারণে মানুষ শুধু তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত হয় না; বরং ব্যাহত তাদের দৈনন্দিন জীবনের অগ্রযাত্রাও। ফলে দেশ ও জাতির সামগ্রিক অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইসলাম সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সব পক্ষের বিরুদ্ধে ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতার প্রতি আল্লাহর অভিশাপ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৩০৯)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর সুশাসন ও দক্ষতা মানব ইতিহাসে স্বীকৃত। তাঁর সময়ে ইসলামী রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করে। বিপুলায়তন অথচ নব-বিকশিত ইসলামী খেলাফতের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও অনিয়ম রোধ করাও এই সময় খুব ছোট চ্যালেঞ্জ ছিল না। ওমর (রা.) এই চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করেন। তাঁর নেওয়া ১০টি পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো—
প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল হওয়ার নির্দেশ
সাধারণ মানুষ ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যকার দূরত্ব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির একটি কারণ। ওমর (রা.) রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতি ফরমান জারি করেন যেন তারা জনগণকে সহজে যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়। তিনি বলেন, ‘মানুষের জন্য তোমার দরজা কখনো বন্ধ করবে না। তাহলে তাদের ক্ষমতাবানরা দুর্বলদের খেয়ে ফেলবে।’ (তাবাকাতে ইবনে সাদ : ৩/৩৩৯)
খলিফা ওমর (রা.) নিজেও ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বপরায়ণ। তিনি রাতের অন্ধকারে ছদ্মবেশে মদিনার পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। আলী ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা.) থেকে বর্ণিত, ওমর (রা.) বলেন, সেই সত্তার শপথ! যিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে নবুওয়াত দিয়ে প্রেরণ করেছেন যদি ফোরাত নদীর তীরে একটি উটের বাচ্চা চুরি হয়, তবে কিয়ামতের দিন তার জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।’ (আবদুল আজিজ বিন মুহাম্মদ, আল মাদিনাতুন নাবাবিয়্যাহ : ২/৬২১)
পরামর্শ ও অনুসন্ধানের পর নিয়োগ
ওমর ফারুক (রা.) রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের পূর্বে ব্যক্তি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন এবং প্রাপ্ত তথ্য ‘মজলিসে শুরা’র সামনে উপস্থাপন করতেন; কোনো এলাকার গভর্নর বা সমপর্যায়ের পদে কাউকে নিয়োগ দিলে সাধারণ মানুষের মতামতও নিতেন। পরামর্শের ভিত্তিতে তার নিয়োগ চূড়ান্ত করতেন। (আস সিয়াতু ফিল ফিকরিল ইসলামী, ড. আহমদ শালবি, পৃষ্ঠা ১৭৭)
নিয়োগের সময় সতর্কীকরণ
ওমর (রা.) কাউকে নিয়োগের সময় প্রশাসনিক কর্মীদের যেকোনো ধরনের দুর্নীতি ও সুযোগের অব্যবহার এবং তার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে বলতেন, ‘আমি মানুষকে এসব বিষয় থেকে নিষেধ করেছি। মানুষ তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যেমন শিকারি পাখি গোশতের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি তোমরা তা করো তবে তারাও করবে এবং তোমরা যদি তা পরিহার করো তবে তারাও তা পরিহার করবে। আল্লাহর শপথ! আমি যেসব জিনিস থেকে নিষেধ করেছি তোমাদের কেউ তাতে লিপ্ত হলে আমি তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেব।’ (আসসিয়াতুল ইসলামিয়া ফি আহদিল খোলাফায়ির রাশিদিন, আবদুল মুতআল সায়েদি, পৃষ্ঠা ১১৯)
প্রশাসনিক নিয়োগে দুই শর্ত
ওমর (রা.) প্রশাসনিক দায়িত্বে কাউকে নিযুক্ত করার আগে তার দুটি গুণ দেখে নিতেন। তা হলো, ক. দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা, দুই. বিশ্বাসযোগ্যতা। এই দুটি গুণের অভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির উদ্ভব হয়। ইউসুফ (আ.) রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণে তার উপযোগিতা বর্ণনার সময় দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার কথাই বলেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ইউসুফ বলল, আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারে দায়িত্ব দিন, (কেননা) আমি উত্তম রক্ষক, অভিজ্ঞ।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৫৪-৫৫)
এ ছাড়া তিনি ব্যক্তির ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, তার ব্যক্তিত্বের প্রভাব, তার প্রতি মানুষের মনোভাব এবং মানুষের প্রতি তার মমত্ব ও কল্যাণকামিতা ইত্যাদি বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি এমন ব্যক্তির সন্ধান করি, যে গোত্রের নেতা (ক্ষমতাশীল) হওয়ার পূর্বে নেতার মতো ছিল। যখন সে তাদের নেতা হলো, তখন তাদেরই একজন (সাধারণ মানুষের মতো) হয়ে গেল।’ (নাজমুল হিকাম ওয়াল ইদারাহ ফিদ-দাওলাতিল ইসলামী, ওমর শারিফ, পৃষ্ঠা ২৭৬)
পদপ্রত্যাশীকে প্রত্যাখ্যান
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অর্পণে ওমর (রা.) সর্বতোভাবে পদপ্রত্যাশীদের প্রত্যাখ্যান করতেন। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি দায়িত্ব লাভে প্রলুব্ধ তার পক্ষে পদের মর্যাদা রক্ষা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। যে নেতৃত্ব লাভে প্রলুব্ধ সে ভারসাম্য রক্ষা করে কাজ করতে পারে না। কেননা পদের প্রত্যাশাই প্রমাণ করে সে তার মাধ্যমে লাভবান হতে চায়। এই লোভ তার যোগ্যতা নষ্ট করে।’ (আস সিয়াতু ফিল ফিকরিল ইসলামী, ড. আহমদ শালবি, পৃষ্ঠা ১৬২)
গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিতদের জন্য ব্যবসা নিষিদ্ধকরণ
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ‘কর্মরত অবস্থায়’ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনকারীদের জন্য ব্যবসা, ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকরি, ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ করেন। যেন তারা এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করতে না পারে। হারিস বিন কাব নামক একজন কর্মকর্তার আর্থিক উন্নতি চোখে পড়লে তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। হারেস বিন কাব বলেন, আমি ব্যবসা করে প্রবৃদ্ধি করেছি। ওমর (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের সেখানে ব্যবসা করতে পাঠাইনি। অতঃপর তিনি তাঁর ‘লভ্যাংশ’ বাজেয়াপ্ত করেন। (আস সিয়াতু ফিল ফিকরিল ইসলামী, ড. আহমদ শালবি, পৃষ্ঠা ১১৯)
আত্মীয়করণ পরিহার
আত্মীয়করণ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অন্যতম কারণ। খলিফা ওমর (রা.) তাঁর শাসনামলে আত্মীয় নিয়োগ থেকে বিরত ছিলেন। তাঁদের ছাড়া যাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.) ও আবু বকর (রা.) কর্তৃক নিয়োগ পান এবং ইসলাম ও মুসলমানের জন্য তাঁদের ত্যাগ ও বিসর্জন সর্বজনস্বীকৃত ছিল। যেমন, সায়িদ ইবনে জায়েদ ও তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা আত্মীয়তার কারণে কাউকে নিয়োগ দিল এবং প্রয়োজনীয় শর্ত বিবেচনা করল না, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ করল।’ (ফসলুল খিতাব ফি আমিরিল মুমিনিনা ওমর ইবনুল খাত্তাব, ড. আলী মুহাম্মদ মুহাম্মদ সাল্লাবি, পৃষ্ঠা ৩৮১)
নিয়োগের আগে-পরে আর্থিক হিসাব গ্রহণ
আর্থিক দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধে ওমর (রা.) কর্মকর্তাদের নিয়োগের আগে ও পরে নিয়মিত সম্পদের হিসাব নিতেন। গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের পর তাঁদের আর্থিক কার্যক্রমও তিনি শর্তাধীন করে দিতেন। এমনকি যাঁদের প্রতি প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ ছিল না তাঁদেরও সম্পদের হিসাব তিনি গ্রহণ করতেন। সম্পদ হিসেবে নগদ অর্থ, স্থাবর সম্পদ, গৃহপালিত পশু, বাহন, পোশাকাদি ও ঘরের আসবাবপত্রের হিসাব নিতেন তিনি। (আস সিয়াতুল ওয়াল মুজতামা ফি আহদির রাশিদিন, পৃষ্ঠা ২৩৯)
অভিযোগের পর দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ
প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার অবাধ সুযোগ ছিল ওমর (রা.)-এর যুগে। জনগণের যেকোনো অভিযোগ তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন এবং দ্রুততম সময়ে তার ব্যবস্থা নিতেন। ব্যক্তি যত প্রভাবশালীই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। প্রখ্যাত সাহাবি ও মিসর বিজেতা আমর ইবনুল আস (রা.)-এর ছেলের বিরুদ্ধে এক মিসরীয়কে প্রহার করার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁদের তলব করেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে জনসম্মুখে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.)-কে প্রহার করার নির্দেশ দেন এবং বলেন, ‘তোমরা কবে থেকে মানুষকে দাস বানিয়ে ফেললে, অথচ তারা স্বাধীন হিসেবে জন্মেছে।’ (ইসলামী কা ইকতিসাদি নিজাম, মাওলানা হিফজুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৯০)
প্রশাসনিক গোয়েন্দা বিভাগ প্রতিষ্ঠা
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধে ওমর (রা.) প্রশাসনিক গোয়েন্দা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন। ফলে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের কাজের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকত। (নিজামুল হুকমি ফিশ-শারিয়াতি ওয়াত-তারিখিল ইসলামী, জাফর আল কাসেমি, পৃষ্ঠা ৫০৬)
এ ছাড়া ওমর (রা.) হজের সময় প্রত্যেক অঞ্চলের প্রশাসনিক প্রধানদের একত্র হওয়ার নির্দেশ দিতেন এবং সমবেত মানুষের মূল্যায়ন গ্রহণ করতেন। ওমর (রা.)-এর সুশাসন ও দক্ষতায় ইসলামী খেলাফত ‘আদর্শ শাসনে’র দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। লেখক নূরনবী যথার্থই বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন ইসলামের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা’। (মুসলমানের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা ১৫৭)