জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি নিয়ে হাজির হলেও শেষ পর্যন্ত সেসবের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয় না। ফলে কোনোভাবেই সংকট থেকে বের হতে পারছে না রাজধানী ঢাকা। তবে এবার নবনির্বাচিত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রকে ভিন্নভাবে দেখছে নগরবাসী। তাঁদের কাছে নগরবাসীর অনেক প্রত্যাশা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী এক বছরে দুই মেয়রকে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। কিছু সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। যেসব সমস্যার সমাধান সিটি করপোরেশনের একার পক্ষেই সম্ভব সেগুলোর ওপরই প্রথম দিকে নজর থাকবে নগরবাসীর। এ ধরনের অন্তত আটটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে দুই মেয়রকে।
চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে—মশক নিয়ন্ত্রণ; বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গতি আনা; জলাবদ্ধতা নিরসন; নতুন ৩৬টি ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়ন; এলাকাভিত্তিক পার্ক, মাঠ ও গণপরিসর নিশ্চিত করা; রাস্তাঘাটের উন্নয়ন; সুশৃঙ্খল গণপরিবহনের ব্যবস্থা ও বায়ুদূষণ রোধ করা। এ ছাড়া প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত রাখাও মেয়রদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় স্থানীয়ভাবে সফলতার বিকল্প নেই। এ জন্য কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন করাটা অত্যন্ত জরুরি।
জানা যায়, নতুন দুই মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে আরো প্রায় দুই মাস সময় লাগবে। এর পরই তাঁদের সামনে মশক নিয়ন্ত্রণই প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ গত বছর রাজধানীবাসীর আতঙ্ক ছিল ডেঙ্গু। সাধারণত এপ্রিলের পর থেকেই শুরু হয় বৃষ্টির মৌসুম। এরপর থেকে নভেম্বর পর্যন্তই থাকে ডেঙ্গুর প্রকোপ। তাই দায়িত্ব গ্রহণের পরই দুই মেয়রকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জোরালো কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এ ছাড়াও বৃষ্টিপাতের পরই শুরু হয় জলাবদ্ধতা। তাই একই সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণ ও জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করতে হবে।
দুই মেয়রই তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে মশা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি জোরদারভাবে রেখেছেন। দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস তাঁর ইশতেহারে পাঁচ রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গণপরিবহন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণসহ নতুন নতুন কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে নজরে এসেছেন ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েকটি বিষয়কে মেয়রদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। প্রথমত, মশা নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। ডেঙ্গুতে আর যেন কোনো প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যানবাহনে অব্যবস্থাপনার সমাধান। যেটা আনিসুল হক শুরু করেছিলেন, কম্পানিগুলোকে এক ব্যবস্থাপনায় আনা। এটার সমাধান যদি তাঁরা করতে পারেন ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে তাঁদের নাম লেখা থাকবে। তৃতীয়ত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। প্লাস্টিককে অন্যান্য বর্জ্য থেকে আলাদা করতে হবে। অন্য বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সম্ভাবনা সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। আবার প্লাস্টিক গলিয়ে ব্লক ইট বানানো যায়; এটা করতে পারলে আমাদের পরিবেশ বাঁচবে। চতুর্থত, দুর্নীতির সর্বগ্রাসী আগ্রাসন থেকে মুক্তির জন্য মেয়ররা একটা উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই মেয়রের উচিত হবে দায়িত্ব গ্রহণ করেই ১০০ দিনের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে স্থানীয় কমিউনিটিকে সব কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে তাঁদের। মূলত সব কাজের জন্য ওয়ার্ড লেবেল কো-অর্ডিনেশন কমিটি করতে হবে। এ ছাড়া প্রত্যেক সিটি করপোরেশনে সব কাজ দেখভালের জন্য যে ১৪টি কমিটি আছে সেগুলো ঠিক করতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এই অধ্যাপক আরো বলেন, ‘দুই সিটি করপোরেশনের নিজেদের পক্ষে যে কাজগুলো করা সম্ভব সেগুলোতে প্রথম দিকে বেশি জোর দিতে হবে। রাজধানীতে ব্যাপক কনস্ট্রাকশনের কাজ হচ্ছে। এগুলো নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। রাস্তাঘাটের সংস্কার তো আছেই। আর বায়ুদূষণ রোধে যে প্রতিষ্ঠানই কাজ করুক না কেন তা দুই মেয়রের নেতৃত্বেই করতে হবে।’
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনেই ১৮টি করে নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। এসব নতুন ওয়ার্ডে নাগরিক সেবা একেবারেই অপ্রতুল। ঢাকা দক্ষিণের নতুন ওয়ার্ডগুলো কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও উত্তরে হাত দেওয়া হয়নি বললেই চলে। তাই নতুন দুই মেয়রের কাছেই নতুন ওয়ার্ডবাসীর প্রত্যাশাও অনেক বেশি থাকবে।
এ ছাড়া দুই সিটির বর্জ্য ফেলার ল্যান্ডফিলই (ভাগাড়) প্রায় ভরাট হওয়ার পথে। উত্তরের ল্যান্ডফিল আমিন বাজারে এবং দক্ষিণের ল্যান্ডফিল মাতুয়াইলে। দুই ল্যান্ডফিল নিয়েই প্রথম থেকেই ভাবতে হবে। তবে স্মার্ট সিটি গড়তে আধুনিক বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত মঙ্গলবার উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যানজট, জলজট ও ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণসহ বেশ কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘রাজধানী ঢাকা একটি অপরিকল্পিত নগর। বিদেশের মতো এখানে কোনো পরিকল্পিত ফুটপাত, ড্রেন, খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার নেই। এমন অপরিকল্পিত শহরকে পরিকল্পনায় ফিরিয়ে আনতে চাইলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সবাই মিলে কাজ করতে পারলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।’
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস নির্বাচিত হওয়ার পর বলেছেন, ‘দায়িত্বভার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাজ শুরু করব। প্রথম ৯০ দিনের মধ্যেই প্রধান মৌলিক নাগরিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করব।’
নগর পরিকল্পনা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রকেই আরো বেশ কিছু ব্যাপারে শুরু থেকেই কাজ করতে হবে। বিশেষ করে নিজস্ব আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়া, জবাবদিহি নিশ্চিত করা, সেবাসমূহ ডিজিটালাইজড করা, বিনোদনের ব্যবস্থা করা, ইচ্ছেমতো রাস্তা খোঁঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা, যাত্রী ছাউনি ও পর্যাপ্ত টয়লেট নির্মাণ, ফুটপাত দখলমুক্ত ও হলিডে মার্কেট স্থাপন, নানা কারণে ঝুঁকিতে থাকা পুরান ঢাকাকে নিরাপদ করা, বাজার মনিটরিং করা, অগ্নিঝুঁকি রোধে যথাসম্ভব তৎপর হওয়া, অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা, নগরীকে সবুজায়ন করাসহ বেশ কিছু বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে।
নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়ররা কী কী করবেন তা তো তাঁরা নিজেরাই ঘোষণা করেছেন। মেয়রদের প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে তাঁদের ঘোষণাগুলো বাস্তবায়ন করা।’ তিনি পথচারী চলাচলের জন্য ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা এবং নারীদের নিরাপত্তার জন্য শহরকে ক্লোজসার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরার আওতায় আনার বিষয়ে মেয়রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘নবনির্বাচিত মেয়রদের কাছে সবার আগে যেটা প্রয়োজন বলে মনে করি সেটা হলো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। কাউন্সিলররা ওয়ার্ডভিত্তিক আর মেয়ররা তাঁদের নগর নিয়ে পাঁচ বছরে বাস্তবায়নের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি পরিকল্পনা তৈরি করবেন।’