বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
অনলাইন ডেস্ক
গত প্রায় ১৯ বছর ধরে দিনাজপুরে ফুলবাড়ী উপজেলার পূর্ব কাটাবাড়ীতে হোমিও চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন আয়েশা সিদ্দিকা। এলাকায় চিকিৎসক হিসেবে বেশ সুনামও আছে তার। এখনো তিনি সপ্তাহে চারদিন রোগী দেখেন। কিন্তু এই হোমিও চিকিৎসকই হতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী কাজি বা নিকাহ্ রেজিস্টার।
ব্যতিক্রমী পেশার স্বপ্নে
২০১২ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফুলবাড়ী পৌরসভায় নিকাহ রেজিস্টার বা কাজি পদের জন্য আবেদন করেন আয়েশা সিদ্দিকা। নিয়োগ বিজ্ঞাপনে কেবল পুরুষ সদস্য আবেদন করতে পারবেন, এমন কোনো কথা লেখা ছিল না। ধাপে ধাপে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে ২০১৪ সালে নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।
নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্তে গঠিত কমিটির সদস্য ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রসহ মোট পাঁচজন। ওই কমিটি নির্বাচিত তিনজন সদস্যের একটি প্যানেল প্রস্তাব দিয়ে চূড়ান্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল।
এরপর মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে কমিটির কাছে জানতে চাওয়া হয়, তারা কাকে নিয়োগ দিতে চান। সেসময় কমিটি চিঠি দিয়ে আয়েশা সিদ্দিকাকে নিয়োগের সুপারিশ করে। কিন্তু কয়েকমাস পরে আয়েশাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছিল যে নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবিত প্যানেল বাতিল করে দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
আদালতে গেলেন কখন?
বিবিসি বাংলাকে আয়েশা সিদ্দিকা জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের ১৬ই জুন আইন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের দ্বারা নিকাহ্ রেজিস্টারের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়’ – এমন মত দিয়ে একটি চিঠি দিয়ে নিয়োগ কমিটির প্রস্তাবিত প্যানেল বাতিল করে।
মনঃক্ষুণ্ণ হলেও তিনি মেনেই নিয়েছিলেন বিষয়টি। কিন্তু এরমধ্যে আয়েশা হঠাৎ জানতে পারলেন, প্যানেলের প্রস্তাবিত তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যিনি একজন পুরুষ এবং সম্পর্কে তার আত্মীয়।
আয়েশা বলেন, ‘এই ঘটনায় আমি খুবই আঘাত পাই মনে। আমার খুব অপমানও লাগে যখন জানতে পারি যে পরীক্ষায় প্রথম হয়েও আমি নিয়োগ পাব না, কারণ আমি নারী।’
বিষয়টি নিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে স্বামীর পরামর্শে আয়েশা আইনি প্রতিকার চাইতে ঢাকায় আসেন। এরপরই আইন মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আয়েশা সিদ্দিকা।
ছয় বছর পরে ২০২০ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি আদালত মন্ত্রণালয়ের মতামতকে বহাল রেখে রায় দেন। সম্প্রতি ১০ই জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, আর তারপরই বিষয়টি সবার সামনে চলে আসে। বিষয়টি নিয়ে দেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে এখনো।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে যে, কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ও সামাজিক বাস্তবতার কারণে দেশের নারীরা নিকাহ্ রেজিস্টার বা কাজি হতে পারবেন না।
আয়েশা জানিয়েছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় এখন প্রকাশিত হলেও, ২০২০ সালে আদালতের রায়ের পরই তিনি আপিল করা সিদ্ধান্ত নেন। ইতোমধ্যে অ্যাপিলেট ডিভিশনে এ নিয়ে একটি আপিল দায়ের করা হয়েছে।
কেন কাজি হতে চেয়েছিলেন আয়েশা?
আয়েশা সিদ্দিকার কাছে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল- নিকাহ রেজিস্টার বা কাজির মত যে পেশায় এখনো পর্যন্ত কোন নারী নিয়োগ পাননি, তেমন একটি পদে তিনি কেন আবেদন করেছিলেন?
জবাবে তিনি বলেছেন, ‘ব্যতিক্রমী কিছু করার জন্য আমি আবেদন করিনি। বিজ্ঞপ্তি দেখে আগ্রহী হয়েছিলাম, কারণ সমাজে গ্রহণযোগ্যতা আছে এই পেশার। তাছাড়া ওই বিজ্ঞপ্তিতে তো উল্লেখ ছিল না যে নারীরা আবেদন করতে পারবে না। আমি যখন দেখলাম যে নারী পুরুষ কিছু উল্লেখ নাই, তখন ভাবলাম – তাহলে আমি তো আবেদন করতেই পারি।’
‘পরে আবেদনপত্র বাছাই, বা পরীক্ষার সময়ও তো আমাকে নারী বলে বাদ দেয় নাই, নিয়োগ কমিটিও তো ফলাফল চূড়ান্ত করে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এই কোনো পর্যায়েই তো আমাকে ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ বা অযোগ্য ঘোষণা করা হয় নাই! তাহলে আমি তো অযোগ্য না।’ বলেন আয়েশা।
আয়েশার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ফুলবাড়ীর পূর্ব কাটাবাড়ীতে। তিন বোন এক ভাইয়ের পরিবারে দ্বিতীয় সন্তান তিনি। বাবাও ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় মাদ্রাসায় পড়তে পড়তেই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় তাকে। বিয়ের পরও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান। একই সঙ্গে ফুলবাড়ীর দারুল সুন্নাহ সিনিয়র সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেছেন, আবার হোমিও কলেজ থেকেও ডিগ্রী নিয়েছেন।
আয়েশা বলেন, ‘ব্যতিক্রমী কিছু করার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু এটা মেনে নেয়া কষ্টকর যে শুধু নারী হওয়ার কারণে আমি অযোগ্য হবো অন্য কোনো কিছুর জন্য।’