বাংলাদেশের সব খেলা কেন বিকেল ৪টায়, অফিস করতে হবে না—বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক চাকরিজীবীর অনুযোগ। এক ফুটবল অনুরক্তের আক্ষেপ—টি-স্পোর্টস তো বিশ্বকাপ দেখাবে, তাহলে এল ক্লাসিকো দেখব কী করে? এক ক্রিকেটই তো দম ফেলার ফুরসত দিচ্ছে না দর্শকদের। গতকাল শুরু হওয়া সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচে ১১৮ রান করা দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫ উইকেটে হারাতে গিয়েও দর্শকদের কম রোমাঞ্চ উপহায় দেয়নি অস্ট্রেলিয়া।

রাতের ম্যাচে গত বিশ্বকাপ ফাইনালের নির্মম প্রতিশোধই নিয়েছে ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুটিয়ে দিয়েছে মাত্র ৫৫ রানে। ৮.২ ওভারেই ৬ উইকেটের জয় তুলে নেয় ওয়ানডের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।

এ দেশের ক্রিকেট আর ইউরোপিয়ান ফুটবলের অনুসারীরা সত্যিই জটিল সংকটে পড়েছেন। এর মধ্যে আজ রাতে আবার ভারত-পাকিস্তান মহারণ। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো ফরম্যাটে এই দুই দলের লড়াইয়ের আকর্ষণ দুই দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না। রাজনীতি, সমাজনীতিও চেপে বসে পাক-ভারত লড়াইয়ে। এই ম্যাচকে ঘিরে বাংলাদেশের ক্রিকেট দর্শকের উন্মত্ততা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও নিজ দলের বাইরে ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট সমর্থক এখনো এ দেশে বেশি।

ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ নিছকই খেলা নয়, এই ম্যাচের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই যেমন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণার পর থেকেই অনেকে ২৪ অক্টোবরের ঘরে গোল চিহ্ন দিয়ে রেখেছে। দুই দেশের সংবাদমাধ্যমের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে, এই একটি ম্যাচই নির্ধারণ করবে শিরোপার গতিপথ। দুই দেশের সমর্থকরা মনে করে—এই একটি ম্যাচ কোনোভাবেই হারা যাবে না।

সীমানার এপার-ওপারের রাজনীতিবিদরা স্টেটমেন্ট দেন। এবার ভারতের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তো ম্যাচটি বাতিলের আহবানও জানিয়েছেন! দুই দেশের বৈরিতার দীর্ঘ ইতিহাস এতটাই প্রভাব ফেলে ক্রিকেট ম্যাচে। সেটির রসায়ন দেখতে ২০০৪ সালে ভারতীয় দলের পাকিস্তান সফর দেখতে জার্মানি থেকে উড়ে এসেছিলেন এক সাংবাদিক! যথারীতি এবারও সুপার টুয়েলভের এই দ্বৈরথই সবচেয়ে বেশি দর্শক টানবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায়। আর লা লিগার বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচ শুরুর সময় সোয়া ৮টা। অগত্যা টি-স্পোর্টস কর্তৃপক্ষ এল ক্লাসিকোর রেকর্ডেড ভার্সন বিশ্বকাপ ম্যাচের পর দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অথচ বিশ্বকাপের মাঠে ভারত ও পাকিস্তানের হার-জিতের খতিয়ান অবিশ্বাস্যরকমের একতরফা। ১২-০, ভারতের পক্ষে! ওয়ানডে বিশ্বকাপে সাতবার আর টি-টোয়েন্টিতে পাঁচবার। ২০০৭ সালে প্রথম টি-টোয়েন্টির শিরোপা ভারত জিতেছিল ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়েই। পরিসংখ্যানে ভারতকেই অবধারিত ফেভারিট মনে হবে। কিন্তু ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি শুরুতেই অতীতকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছেন, ‘আমরা কখনোই আমাদের রেকর্ড কিংবা নৈপুণ্য নিয়ে আলোচনা করি না। এসব নিয়ে ভাবলে ফোকাস নড়ে যায়। মূল বিষয় হলো, আমরা কিভাবে প্রস্তুতি নিলাম, নির্দিষ্ট দিনে সেসব মাঠে ঠিকঠাক করলাম কি না। প্রতিপক্ষ কোন দল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ না।’ তবে তিনি জানেন, ‘আমি মনে করি পাকিস্তান খুবই শক্তিশালী দল। ওদের দলে কখনোই প্রতিভাবান ক্রিকেটারের অভাব ছিল না। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেরা ক্রিকেটটাই খেলতে হবে।’

আমিরাতে একসময় দুই দলকে নিয়মিত খেলতে দেখা যেত। ক্রিকেটজুয়ার অভিযোগে আইসিসির কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে শারজায় বলে-কয়ে ভারতকে হারাত পাকিস্তান। শারজা থেকে দুবাই তো মোটে মিনিট বিশেকের ড্রাইভ। বাবর আজমরা কি পারবেন আরবদেশে নব্বইয়ের দশকের মতো আজ ভারতের ওপর ছড়ি ঘোরাতে?

পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ ভুলে পুরো মনোযোগ রাখছেন বর্তমানে, ‘সত্যি কথা হলো, অতীত নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। ম্যাচের দিন আমরা আমাদের সবটুকু সামর্থ্য আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে ভালো ফল বের করার চেষ্টা করব। তা ছাড়া রেকর্ড তো ভাঙার জন্যই।’

বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে টানা হারের বৃত্ত ভাঙার শক্তিও আছে পাকিস্তানের। অধিনায়ক নিজে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানদের অন্যতম। বাবর আজমের নেতৃত্বে তারুণ্যনির্ভর দলে আছেন শোয়েব মালিক ও মোহাম্মদ হাফিজের মতো অভিজ্ঞ অলরাউন্ডারও। সঙ্গে আছে অন্য এক জেদ। অতি সম্প্রতি নিরাপত্তার অজুহাতে পাকিস্তান সফর বাতিল করেছে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। সেই থেকে দেশটির প্রধান ক্রিকেট কর্তা রমিজ রাজা থেকে শুরু করে বাবর আজমদের প্রতি আপামর ক্রিকেট অনুরক্তের দাবি—‘তোমরা বিশ্বকাপ জিতে জবাবটা দাও!’ নিঃসন্দেহে আবেগতাড়িত দাবি। তবে আবেগের নৌকায় চেপে কিন্তু ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান! ইংল্যান্ডের ওই আসর শুরুর মাস তিনেক আগে লাহোরে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশে ফিরে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল।

মাঠের লড়াই কি আর আবেগ দিয়ে জেতা যায়? লড়াইয়ের ময়দানে অতীত-ভবিষ্যৎ হারিয়ে যায় বর্তমানের ঝোড়ো হাওয়ায়। টি-টোয়েন্টিতে তো রীতিমতো তাণ্ডব চলে! মুহূর্তে বদলায় ম্যাচের রং। দুবাই স্পোর্টস সিটির উইকেটের চরিত্রের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান খুবই পরিচিত। পাকিস্তান তো দীর্ঘকাল তাদের হোম ম্যাচ খেলছে এখানে। আর সর্বশেষ আইপিএলের শেষাংশ খেলে বিরাট কোহলিরাও আমিরাতের মাটি চিনে ফেলেছেন। তাই কন্ডিশন দুই দলের ব্যবধান গড়ায় বড় কোনো ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা কম।

বলা যায়, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডই পাচ্ছে দুই দল। ব্যবধান গড়বে ব্যাট-বলের লড়াই। সেটিও নির্দিষ্ট দিনে, মানে আজকের নৈপুণ্য দিয়ে। বিশ্বকাপের কিংবা আমিরাতের অতীত কোনো ভূমিকা রাখবে না। ম্যাচ শেষে পরিসংখ্যানে শুধু যুক্ত হবে ভারত-পাকিস্তান আরেকটি মহারণের ফল।