বাংলাদেশের আশি ভাগ মানুষই গ্রামে বাস করে। যারা বিদেশ থেকে এসেছে তার বেশিরভাগই গ্রামেরই মানুষ।
এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যখন একইসাথে পরিবহনে ঠাসাঠাসি করে বাড়িতে ফিরলো, তখন অনেকেই সংক্রমিত হয়ে ফেরার সম্ভাবনাও বেড়ে গেল।
শহর বা বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের প্রতি গ্রামের মানুষ একটু বেশি আকর্ষণ অনুভব করে। তার সাথে কথা বলা, হাত মেলানো বা কোলাকুলি করতে পারাটা অনেক গ্রামের মানুষ গৌরবের মনে করে।
গ্রামের মানুষ বেশি উৎসুক। সেখানে একটা প্রাইভেট কার গেলেই বিশ-পঞ্চাশ জন মানুুষ অযথা জটলা তৈরি করে। যা গ্রামে সংক্রমণের সম্ভবনাকে বাড়িয়ে তোলে। শহুরে শিশুদেরকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব, কিন্তু গ্রামের শিশুদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। এখানে মা-বাবারাও ততটা সচেতন না। তাছাড়া বাধা দিয়েও শিশুদের খেলার মাঠ থেকে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা যেকোনো মূল্যে প্রতিবেশি শিশুর সাথে খেলায় যোগ দিচ্ছে। সেই প্রতিবেশি শিশুদের মধ্যে আবার কেউ আছে বাইরে থেকে আসা।
এবার গ্রামের হাট-বাজার প্রসঙ্গ আসি। গ্রামের হাট মনেই তো বোঝেন কি ভীষণ ঠ্যালা-গুতা। সেখানে নিরাপদ দূরত্ব মেনে বাজার করা একেবারেই অসম্ভব।
আর গ্রামের পাইকারী বাজার বন্ধ করলে গ্রাম ও শহরের মানুষ কাঁচামাল পাবে কোথায়? হাটের হট্টগোল কমাতে এখুনি প্রয়োজন হাট সংলগ্ন পাঁচ-সাত বিঘা চাষের জমিকে অস্থায়ী লিজ নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দোকান বসানো।
গ্রামের চায়ের দোকান করোনা বিস্ফোরণের আরেক মরণ ফাঁদ। এখানে গ্রামের সবথেকে বিজ্ঞ ব্যাক্তিরা জটলা পাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সংবাদ শুনছেন ও করোনা ব্যাপারে দার্শনিত উক্তি প্রয়োগ করছেন। শহরের চা দোকানগুলো প্রশাসন বন্ধ করে দিলেও গ্রামে তা এখনও সম্ভব হয়নি।
গ্রামের মানুষ এখনও করোনা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন না। এখানে শিশুদের নাকে প্রায় সময় সর্দি লেগেই থাকে। সেজন্য করোনা ভাইরাসের কারণে সর্দি-কাশিকেও এরা সাধারণ বলে ভুল করতে পারে। এখানে অধিকাংশ মানুষ পত্রিকা বা ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে। অনেকে সারাদিন খাটা-খাটনির পরে সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে পরে। তাদের কথা ‘খেয়েই ঘুম, উঠেই বাথরুম’। অত-শত সংবাদের ধার তারা ধারেন না।
গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পল্লী-চিকিৎসকের নিকটে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এখন আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে প্রচুর মানুষ ফুসফুসের অসুখে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন। তার মধ্যে যদি কেউ করোনা রোগী থাকে, তবে প্রথমে ডাক্তার আক্রান্ত হবেন এবং সেইসাথে নীরবে রাতারাতি পুরো গ্রামবাসী আক্রান্ত হবেন। কেউ জানতেও পারবেন না। কারণ, এখানে যেমন কোনো পরীক্ষার সুযোগ নেই তেমনি ডাক্তারের করোনা মোকাবেলার কোনো প্রশিক্ষণ বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও নেই। আবার অনেক বেসরকারী ডাক্তার তো চিকিৎসা বন্ধই করে দিয়েছেন। যেহেতু তার নিজের নিরাপত্তা নেই, কোনো বীমা নেই, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা নেই, সেজন্য খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি সেবাপ্রদান বন্ধ রেখেছেন।
বিষয়টা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগীটি মারা গেল’। আসল কথা হচ্ছে জনগণকে নিয়েই সরকার। সরকারের একার পক্ষে এই মহাদুর্যোগ মোকাবেলা করা কঠিন। সকলকেই সচেতন হতে হবে। সেইসাথে সরকারেরও উচিৎ গ্রামপর্যায়ে ব্যাপকভাবে মাইকিং করে জনগণকে সচেতন করা। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
এতদিন শিখেছি একতাই বল। এখন শিখতে হবে একাকিত্বই জীবন। কিছুদিন একা থাকতে হবে, জীবনকে বাঁচাতে হবে। এই প্রত্যয় নিয়ে সবাই মিলে করোনাকে মোকাবেলা করতে হবে।