এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে আধাপাকা বোরো ধানগুলো সোনালি রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে। সপ্তাহ খানেক আগে থেকে কৃষকরা ধান কাটা শুরু করেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের আতঙ্কের কারণে এবার কিছুটা শ্রমিক সংকট থাকায় কৃষকরা জমির পাকা ধান কাটতে পড়েছেন বিপাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি আর বজ্রপাত আতঙ্কের মধ্যে করোনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে কৃষকের মনে। এই অবস্থায় কৃষকরা কষ্টের ফসল মাঠে ফেলে রাখতে চান না। হাওরের পাকা ধান গোলায় তোলতে মরিয়া হয়েছেন তারা। করোনার ভয় তাদের ধমিয়ে রাখতে পারেনি। 

তাদের মনে একটাই প্রশ্ন, সময়মত কি ধান কেটে গোলায় তুলতে পারবেন। অনেকটা মনের আনন্দে আবার অনেকটা কষ্ট নিয়ে বোরো ধান কাটছেন হাকালুকি তীরের কৃষকরা। তবে কুলাউড়া কৃষি বিভাগ বলছে, বিগত ৫-৬ বছর থেকে বাইরের কোনো এলাকা থেকে কোনো শ্রমিক হাকালুকিতে ধান কাটতে আসেনি। কুলাউড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে এই মৌসুমে শ্রমিকরা ধান কাটতে আসেন।

হাওর তীরের কৃষকের গোলায় বোরো ধান ওঠা নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। কেননা এখানে ভারী বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ি ঢল নেমেই প্রথমে বোরো ধান তলিয়ে দেয়। ফলে কৃষকের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকাটা স্বাভাবিক। জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ি উপজেলায় শত শত একর জমির বোরো ধান কাটাতে মাঠে নেমেছেন গ্রামের স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার হাকালুকি হাওর এলাকা ঘুরে জমিতে স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ধান কাটাতে দেখা গেছে।

সরেজমিন বৃহস্পতিবার হাওরের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, পুরুষের সঙ্গে সমানতালে মাঠে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন নারী ও শিশু। পুরুষরা ধান কাটছেন এবং পাশের খালি জায়গায় রাখছেন। একদল পুরুষ ধান মেশিনে মাড়াই করছেন। আর পুরুষের পাশাপাশি নারীরা এই ধানগুলো খলায় নিয়ে শুকানোর কাজ করছেন। তাদের সাথে সঙ্গ দিচ্ছেন পরিবারের শিশু সদস্য ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে এই ধানগুলো ঠেলা ও ট্যাক্টরযোগে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন একদল কৃষক।

কৃষকরা জানান, বোরো মৌসুমে ধান কাটার সময় হাওরের চাষি পরিবারের নারী পুরুষ সাধারণত বাড়িতে থাকেন না। সবাই হাওরে গিয়ে একত্রে কাজ করেন। কিছু কৃষক বোরো ধানে ভালো ফলন পাওয়ায় তারা বেজায় খুশি। আবার কিছু কৃষক ফলন ভালো না হওয়ায় হতাশায় পড়েছেন।

কুলাউড়ার ভূকশিমইল ইউনিয়নের কৃষক আকমল আলী, আজমল আলী, মছদ্দর আলী, ভাটেরা ইউনিয়নের বেড়কুড়ি তীরের কৃষক আব্দুর রহিম, জয়চন্ডী ইউনিয়নের মীরশংকর গ্রামের কৃষক মকদ্দস আলী, আখদ্দস মিয়া জানান, প্রচন্ড খরার কারণে এবার ধানের ফলন তেমন ভালো হয়নি। কোনো বৃষ্টিপাতও হয়নি। প্রতিবছর বোরো ধান কাটার মৌসুমে বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষি শ্রমিকরা হাকালুকি হাওরে আসতেন। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর এখনো কোনো শ্রমিক না আসায় আমরা কৃষকরা জমির পাকা ধান নিয়ে বেকায়দায় পড়েছি। বাধ্য হয়ে কৃষকরা নিজেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ধান কাটা শুরু করেছি।

হাওরপাড়ের কৃষক বরকত আলী জানান, আমি এবার প্রায় ৭ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছি। এবার খরার কারণে ধানের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ৭-৮ হাঁটু ধান পেতে পারি। গত বছর এই ৭ একর জায়গায় আমি ১৫ হাঁটু ধান পেয়েছিলাম। 

কৃষকরা জানান, সপ্তাহ খানেক সময়ের ভিতরে জমির ধান না কাটতে না পারলে ধান নষ্ট হয়ে যাবে। সবসময় নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কাজ করছে। অন্যান্য জাতের ধান আগামী ১০ দিনের মধ্যে কেটে শেষ করতে হবে। তা না হলে হাওরে পানি চলে আসতে পারে। এখন কী করবো আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। দেশের মোট বোরো ফসলের প্রায় ১৯ শতাংশ আসে এসব হাওর থেকে। গত দুই বছর অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে কৃষকরা বোরো ধান ঘরে উঠাতে পারেননি। এতে এক ফসলি জমির ওপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার পরিবার অনেকটা নিঃস্ব হয়ে গেছে।

অনেক কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হাওরের ভিতরে কয়েকটি ছড়া-খালে পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। শুষ্ক মৌসমে পানির ব্যবস্থা থাকলে আমাদের চাষাবাদে অনেক সুবিধা হতো। তাছাড়া সরকারি কোন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিনা। এদিকে ফানাই নদী খননের কারণে উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার, কাদিপুর, বরমচাল, ভাটেরা ইউনিয়ন ও ভূকশিমইল ইউনিয়নের আংশিক এলাকার অনেক কৃষক এবার বোরো ধান আবাদ করতে পারেনি।

বিপর্যস্ত কৃষকরা বলেন, আমাদের কষ্ট দেখে এলাকার স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা আমাদের ধান কেটে দিচ্ছে। আমাদের গ্রামের স্কুল, কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ধান কেটে কৃষকদের সহায়তা করায় আমরা জমির পাকা ধান ঘরে তুলতে পারছি এটি একটি ভালো উদ্যোগ।

হাকালুকি হাওর তীরের ছকাপন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র জয়দেব ও ভূকশিমইল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র সিপার জানায়, করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ থাকায় আমরা এখন অবসর সময় কাটছি। তাই স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নিজের ও প্রতিবেশীদের জমির ধান কেটে দিচ্ছি। তারা বলেন, আমরা ২০-২৫ জনের একটি দল কৃষকদের দুর্ভোগের কথা ভেবে ধান কাটার কাজ করছি। পারিশ্রমিক হিসেবে কৃষকরা আমাদের যা দিচ্ছেন তাই নিচ্ছি। 

হাকালুকি হাওর তীরের ভূকশিমইল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়া তারেক আহমদ (১৭) ও তার সহোদর একই প্রতিষ্ঠানের ৭ম শ্রেণির ছাত্র তাহের আহমদকে ধান কাটতে দেখা গেছে। ধান কাটার সময় তারা দুই ভাই জানান, করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় হাওরতীরের হোসেন আলী নামের এক কৃষকের এক কেয়ার ধান ১৬০০ টাকার বিনিময়ে আমরা কেটে দিচ্ছে। 

কুলাউড়া কৃষি বিভাগ জানায়, হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়ায় গত বছর ছয় হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। এবার কুলাউড়ায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কৃষক বোরো ধান আবাদ করেছেন। হাকালুকি হাওর তীরের ভূকশিমইল, ভাটেরা, বরমচাল, কাদিপুর, জয়চন্ডী ও ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের অংশে কৃষকরা ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান- ২৯, ব্রি ধান-১৪, ব্রি ধান-৮৪ জাতের বোরো ধান আবাদ করেছে। বিশেষ করে হাকালুকি হাওরে বিভিন্ন ছড়া বা খাল খনন করলে কৃষকদের জন্য অনেক সুবিধা হতো। খননের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন দেখভাল করে। 

কুলাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জগলুল হায়দার বলেন, কুলাউড়ায় এবার ৬ হাজার ৯ শ’ ২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ৬ শ’ হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা চিন্তা করে সরকারি নির্দেশে মাঠ পর্যায়ের কৃষি উপসহকারী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কৃষকদের জানানো হয়েছে যে, ৮০ শতাংশ ধান পাকা হলে ধান কাটা শুরু করতে হবে। তাহলে কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের ধান কাটার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে ধান কাটার জন্য এক এলাকার শ্রমিক অন্য এলাকায় যেতে চাইলে জেলায় চলমান লকডাউনে কোন সমস্যা হবে না। বরং প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদেরকে সার্বিক সহায়তা করা হবে