করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আপাতত ঈদ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে করোনাভাইরাসের যে পরিস্থিতি তাতে ঈদের পর স্কুল-কলেজ খোলার মতো পরিস্থিতি নেই। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে বলে এক অনুষ্ঠানে ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) পরীক্ষা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। উত্তরণের পথও খুঁজে পাচ্ছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, আগামী আগস্ট বা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলে কিভাবে পরবর্তী পর্যায়ে পড়ালেখা চলবে তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এনসিটিবিকে বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা তৈরির মৌখিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তারা মূলত দুটি প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে। প্রথমটি হচ্ছে—সিলেবাস ও ঐচ্ছিক ছুটি কমিয়ে চলতি বছরেই সব পরীক্ষা শেষ করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে—আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাবর্ষ বাড়ানো। অর্থাৎ চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ হবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আর আগামী শিক্ষাবর্ষ শুরু হবে ২০২১ সালের মার্চ মাসে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে একটি মিটিং করেছি। সেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মূলত দুটি প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু কবে নাগাদ করোনার প্রকোপ শেষ হবে, আর কবে স্কুল-কলেজ খুলবে সেটার ব্যাপারে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা না পেয়ে এগোতে পারছি না। তবে আমরা আরো বৈঠক করব।’
এনসিটিবির চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘যদি আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে স্কুল খোলে তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল চলতি শিক্ষাবর্ষকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। ফেব্রুয়ারিতেই বার্ষিক পরীক্ষাসহ অন্যান্য পরীক্ষা নেওয়া। এতে শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে পড়ে ও শিখে পরবর্তী শ্রেণীতে উন্নীত হতে পারবে। আর পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ ২০২১ সালের মার্চ থেকে শুরু করা। আগামী শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন ধরনের ছুটি কমিয়ে ১০ মাসে শিক্ষাবর্ষ শেষ করা। তবে বিকল্প প্রস্তাবও এসেছে। সেখানে ২০২০ সালের মধ্যেই সব পরীক্ষা শেষ করার কথা বলা হয়েছে। এতে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা ও ঐচ্ছিক ছুটি কমানোর কথা বলা হয়েছে। কবে নাগাদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারে, সেটা মোটামুটিভাবে জানতে পারলে আমরা চূড়ান্ত প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে পারব।’
জানা যায়, গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে এই পরীক্ষাসূচি স্থগিত করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আগে হরতাল-অবরোধেও একাধিকবার পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। কিন্তু স্থগিতের দিনই পরিবর্তিত তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসে গতিবিধি বোঝা না যাওয়ায় নতুন কোনো পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করতে পারছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে অনিশ্চয়তায় দিন পার করছে প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষার্থী। এমনকি চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশের কথা থাকলেও তা করা যাচ্ছে না।
প্রতি বছর নভেম্বর মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী-পিইসি ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী-জেএসসি পরীক্ষা। কিন্তু প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সংসদ টেলিভিশনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস প্রচার করলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা খুব একটা এগোচ্ছে না। এ অবস্থায় সিলেবাস শেষ করা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।
রাজধানীর মনিপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর এক অভিভাবক লতিফুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস হচ্ছে। যা শিক্ষার্থীদের চাঙ্গা রাখছে। কিন্তু দেখা যায়, আজ একটি ক্লাস হচ্ছে, সেটি আমার বাচ্চা আগেই পড়ে ফেলেছে। আবার আরেকটি ক্লাস হচ্ছে যার আগের দুই-তিনটি অধ্যায় এখনো পড়া হয়নি। ফলে ধরতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
তবে শঙ্কায় আছে জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষার্থীরা। কারণ তারা এই পরীক্ষা শেষে একটি সার্টিফিকেট পায়। ফলে সবাই এই পরীক্ষায় ভালো করতে চায়। ‘এ প্লাস’ পেতে বছরজুড়েই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের কোচিং-প্রাইভেট পড়ে। দিন-রাত পড়ালেখা করে। কিন্তু এবার সব কিছুই বন্ধ।
লাভলী আক্তার নামে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীর এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার বাচ্চার পড়ালেখা শেষ না করে যদি পরীক্ষা নেয়, তাহলে সে ভালো ফল করতে পারবে না। এতে সারা জীবনের জন্য একটা অসন্তুষ্টি থেকে যাবে। তাই খুবই চিন্তায় আছি।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অন্তত ১৫ দিন পর থেকে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আর এনসিটিবির সঙ্গে বসে অন্যান্য পরীক্ষার ব্যাপারে আমরা একটি যুঁতসহ সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’