বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরা0সের সংক্রমণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। কভিড-১৯-এর করাল থাবায় বিশ্ব আজ লণ্ডভণ্ড। সারা বিশ্বে দুই লাখের বেশি মানুষ এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র ঠেকাতে পারছে না তাদের মৃত্যুর মিছিল। করোনার হিংস্রতায় ইউরোপ ছিন্নভিন্ন। বিগত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সংকটে বিশ্বের তাবত্ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হতভম্ব! দিশাহারা বিশ্ববাসী!

১৬ কোটি জনসংখ্যার অতি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলা করা অন্যান্য দেশের চেয়ে ভিন্নতর। এ ভাইরাসজনিত কারণে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল মানুষের কাছে একদিকে যেমন ত্রাণ পৌঁছে দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে আগাম বন্যার আগেই হাওরের ধান যথাসময়ে কাটার ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ও সরবরাহ শৃঙ্খল রাখতে হচ্ছে স্বাভাবিক। আবার শিল্পোদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গার্মেন্টকর্মী, পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক ও রিকশাচালকসহ সবাই যেন তাদের নিজ নিজ ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারে,  সে জন্য সরকারকে খাতভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ ও আর্থিক সহায়তা দিতে হচ্ছে। আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী মানুষের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাকে নিশ্চিত করতে হচ্ছে। এ জন্য দেশের প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত বহুমাত্রিক কার্যক্রম শুরু করছে সরকার। এ বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়কের মতো বঙ্গবন্ধুকন্যা গণভবন থেকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিনিয়ত সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং ও সমন্বয় করে চলেছেন।
গত ডিসেম্বরের শেষে চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পরপরই দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা ও আইইডিসিআর যৌথভাবে কাজ শুরু করে। আইইডিসিআরে কন্ট্রোল রুম খোলা হয় এবং রোগটি মোকাবেলায় প্রস্তুতি শুরু করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পৃথক পৃথক কন্ট্রোল রুম চালু করা করে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ভাইরাসসহ সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করে প্রণয়ন করা হয় National Preparedness and Response Plan to COVID-19, Bangladesh. 

পরিকল্পনার আওতায় তিন স্তরবিশিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় :
১) বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের মাধ্যমে যেন ভাইরাস না ছড়ায়, সে জন্য বিদেশে গমন এবং বিদেশ থেকে আগমন নিরুত্সাহ করা।
২) দেশের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির আগমন ঘটলে দ্রুত শনাক্তকরণ এবং এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাসের বিস্তার রোধ।
৩) চিহ্নিত আক্রান্ত ও অসুস্থ ব্যক্তিদের দ্রুত পৃথক করে যথাযথ চিকিত্সা প্রদান।
গত জানুয়ারি থেকেই এই তিন স্তরের কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়। দেশের সব বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং স্থলবন্দরে বিদেশ প্রত্যাগত যাত্রীদের থার্মাল স্ক্যানার ও ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের মাধ্যমে স্ক্রিনিং করা হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় কমিটি এবং বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও কমিটি গঠিত হয়েছে। জাতির পিতার কন্যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী বর্তমানে ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে কভিড-১৯ রোগের পরীক্ষা এবং চিকিত্সা সুষ্ঠুভাবে চলছে।
গত ৩১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ৬৪টি জেলার জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিভিন্ন দপ্তরের মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে একযোগে ভিডিও কনফারেন্সে গণভবন থেকে সরাসরি কথা বলেন। এরপর পর্যায়ক্রমে বিভাগওয়ারী প্রতিটি জেলার সঙ্গে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে চলমান কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে ভিডিও কনফারেন্স চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তিনি প্রান্তিক পর্যায়ের খোঁজখবর নেন, সমস্যা জানতে চান এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। সবাইকে তিনি অবিরাম সাহস জুগিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬৪ জেলায় কভিড-১৯ প্রতিরোধ ও ত্রাণ বিতরণসহ সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে সরকারের ৬৪ জন সিনিয়র সচিবকে দায়িত্ব দিয়েছেন। জাতির এই ঘোরতর সংকটে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের একটি জেলার সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে তিনি একজন বিচক্ষণ ব্যবস্থাপকের মতো কাজ করেছেন। 
লকডাউনের কারণে ধান কাটার জন্য কৃষিশ্রমিকের অভাব দেখা দিতে পারে মনে করে জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নিজের রাজনৈতিক দল এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধান কাটার আহ্বান জানান। নেত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগ সফলতার সঙ্গে সারা দেশে ধান কাটা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আগাম বন্যার আগেই যথাসময়ে পাকা ধান ঘরে তুলতে পারছে কৃষক।
ডাইনামিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সময়মতো ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে এখনো বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ ঘটেনি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত ৮ মার্চ দেশে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়, সেদিনই তত্ক্ষণাত্ গণভবনে সভা ডেকে ‘মুজিববর্ষের’ সব অনুষ্ঠান স্থগিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ছিল গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য। জনমানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে তাই জাতির পিতার কন্যা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি দীর্ঘদিনের আরাধ্য বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা স্থগিত করতে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়। গত ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালতে সাধারণ ছুটি বলবত্ রয়েছে। জরুরি সেবা কার্যক্রম ছাড়া সব কিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। স্থগিত রয়েছে গণপরিবহন, রেল ও বিমান চলাচল।
বঙ্গবন্ধুকন্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং অপ্র্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করেছেন। বিনা মূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ; ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রয়; লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ; বয়স্কভাতা এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতার আওতা সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করা; এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত অন্যতম কার্যক্রম গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহনির্মাণ—এই কর্মসূচিগুলো করোনা পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত বাস্তবায়ন করছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় এরই মধ্যে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যা জিডিপির ৩.৫ শতাংশ। ১০ টাকায় চাল পেতে নতুন ৫০ লাখ রেশন কার্ডসহ মোট এক কোটি রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে এক কোটি পরিবারের পাঁচ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। পোশাক শ্রমিকদের শতভাগ বেতন নিশ্চিত করতে তিনি পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। তা ছাড়া কৃষি ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করেছেন তিনি। বোরো মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ ২১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সরকারিভাবে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী বাজেটে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খাদ্য উত্পাদন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কৃষকের কাছে বীজ, সার, কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করার যাবতীয় নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। 
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সম্মুখ সারির যোদ্ধা নিবেদিতপ্রাণ চিকিত্সক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রত্যক্ষভাবে করোনা রোগীদের নিয়ে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশেষ পুরস্কার ও প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন তিনি। এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ডাক্তার, সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী ও বিজিবি সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারীদের জন্য বিশেষ বীমা ব্যবস্থা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দায়িত্ব পালনকালে যদি কেউ আক্রান্ত হন, তাহলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য থাকছে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমা এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্যবীমা ও জীবন বীমা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা।
এই চরম দুঃসময়েও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর কথা ভোলেননি মাদার অফ হিউম্যানিটি শেখ হাসিনা। সার্বিক পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ-বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় দ্রুততার সঙ্গে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করা হয়েছে। কানাডিয়ান লেখক অভিভাহ ভিটেনবার্গ-কক্স তাঁর এ নিবন্ধে লেখেন,  “শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৬ কোটি ১০ লাখের মতো মানুষের দেশ বাংলাদেশ সমস্যা-সংকটের সঙ্গে অপরিচিত নয়। তিনি এই সংকট মোকাবেলায় দ্রুত সাড়া দিয়েছেন, যাকে ‘প্রশংসনীয়’ বলেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম।”
দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছেন আজকের পরিপক্ব রাজনীতিবিদ ‘শেখ হাসিনা’। প্রবল দেশপ্রেম এবং গণমানুষের প্রতি তীব্র দায়বদ্ধতা ‘জননেত্রী’ হিসেবে তাঁকে পরিচিত করেছে। তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন-অভিজ্ঞ সরকারপ্রধান হিসেবে তাই তিনি দ্রুততার সঙ্গে নিতে পেরেছেন একের পর এক সঠিক ও কার্যকর সিদ্ধান্ত। আমেরিকান লেখক জন ক্যালভিন ম্যাক্সওয়েলের ভাষায়— 
The pessimist complains about the wind.
The optimist expects it to change. 
The leader adjusts the sails.
একজন দক্ষ নেতার মতো sails adjust করেই দেশ ও দেশের মানুষকে আশার আলো দেখিয়ে যাচ্ছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা; আবির্ভূত হয়েছেন বাঙালির ‘বাতিঘর’ হিসেবে। এই গভীর সংকটের সময় শেখ হাসিনার মতো একজন সাহসী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতাকে আমরা দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে পেয়েছি—এ জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব-১