সুপার সাইক্লোন আম্ফানের তাণ্ডবে দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গতকাল বুধবার (২০ মে) দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে তাদের।
সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে কালের কণ্ঠ প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে গতকাল দুপুরে বরগুনায় এক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া ঝোড়ো বাতাসে গাছ ভেঙে পড়ে ভোলার চরফ্যাশনে মারা গেছেন একজন। একইভাবে পটুয়াখালীর গলাচিপায় মারা গেছে এক শিশু। জেলার কলাপাড়ায় নৌকা ডুবে মারা গেছেন সিপিপির এক টিম লিডার। গাছের ডাল ভেঙে পড়ে সাতক্ষীরা সদরের কামালনগরে মারা গেছেন এক নারী। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ঘরের দেয়াল ধসে চাপা পড়ে মারা গেছেন একজন।
এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় চলাকালে যশোরের চৌগাছায় গাছ উপড়ে তার নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে এক মা ও তাঁর মেয়ের। আর চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে জোয়ারের পানিতে ডুবে মারা গেছেন মো. সালাউদ্দিন (১৮) নামের এক যুবক। গতকাল বুধবার দুপুরে সন্দ্বীপ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
এদিকে, আম্ফানের প্রভাবে বৃষ্টিপাত ও দমকা বাতাসের কারণে উপকূলীয় নদ-নদীগুলো উত্তাল হয়ে ওঠায় সাতক্ষীরা, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। অনেক স্থানে ফাটল ধরেছে বাঁধে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর অন্তত ২৪ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
সমুদ্রে গর্জন, উঁচু উঁচু ঢেউ, জলোচ্ছ্বাস, প্রবল বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া-এমন রুদ্রমূর্তি নিয়ে স্থলভাগে তাণ্ডব চালিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করেছে ১৯৯৯ সালের পর প্রথম সৃষ্ট সুপার সাইক্লোন আম্ফান। ভয়ংকর আম্ফান তছনছ করেছে গাছপালা, মানুষের ঘরবাড়ি।
আম্ফান উপকূলে আছড়ে পড়ার আগেই গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উপকূলীয় নদ-নদীগুলোর পানি ৩ থেকে ৬ ফুট বেড়ে যায়। এ কারণে পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রাত পর্যন্ত শতাধিক গ্রাম তলিয়ে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। আম্ফান যখন উপকূলে আছড়ে পড়ে, তখন ৫-১০ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পুরো অঞ্চলজুড়ে লাখ লাখ মানুষের বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ।
আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, ভারতের সমুদ্র উপকূল দিঘা, বকখালী, কাকদ্বীপ, তাজপুর ও সুন্দরবন অংশে তাণ্ডব চালিয়ে আম্ফানের অগ্রভাগের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করে গতকাল বিকেল ৪টা থেকে। সুপার সাইক্লোনিক ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সাতক্ষীরা-খুলনা দিয়ে প্রবেশ করে ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার বেগে। ঘূর্ণিঝড়টি সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা দিয়ে পরবর্তী তিন থেকে চার ঘণ্টায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করে। যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুুর ও গাইবান্ধা হয়ে আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে রাত ১টার দিকে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ব্যাস ছিল ৪০০ কিলোমিটার। এর প্রভাবে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ১৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি বলেন, আম্ফানের প্রভাবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপত্সংকেত বহাল আছে। এ ছাড়া উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখলী, বরিশাল, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাদপুর এবং এসব জেলার দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপত্সংকেতের আওতায় রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
রবিবার লঘুচাপ থেকে তৈরি হয় সুস্পষ্ট লঘুচাপ। সেখান থেকে নিম্নচাপ, তারপর গভীর নিম্নচাপ থেকে সোমবার ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সাগরে অবস্থান করে। এরপর মঙ্গলবার আম্ফান সুপার সাইক্লোনিক ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।