শিক্ষার্থীরামেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপঃ
করোনা এ যেনো এক আতংকে নাম। পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। প্রতিদিনই মৃত্যুর সারিতে যোগ হচ্ছে হাজার, হাজার লাশ। এখন পযন্ত করোনা বিস্তারের একটি কারন বেশি করে লক্ষ্য করা গেছে। সেটি হলো অসচেতনতা। পৃথিবীর যতো গুলো দেশে আজ করোনা ভয়ানক হয়ে উঠেছে তার জন্য তাদের খামখেয়ালী ও অসচেনতাই দায়ী।
বাংলাদেশ এদিক থেকে ব্যাতিক্রম। প্রথম থেকেই সতর্ক। করোনা মোকাবেলায় প্রথম থেকেই জনসমাগম হয় এমন সব কার্যকর বন্ধ ঘোষণা করেছে। প্রথম দিকে সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনা করলেও পরবর্তীতে সকল অফিস, আদালত ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকারের এ পদক্ষেপের ফলে করোনা অনেকাংশে মোকাবেলা করা সম্ভব হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা চরম সংকটের মধ্যে পরেছে। ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাস এর কারণে এবারের এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা গত ১ লা এপ্রিল হওয়ার কথা ছিল।
দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে শিক্ষা খাতে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে শিক্ষা ব্যবস্থা কিরুপ হবে তা নিয়ে চিন্তিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী সহ অভিভাবকবৃন্দরা ও। ভবিষ্যৎ পাঠদান নিয়ে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে ও বিরাজ করছে স্থবিরতা। করোনায় শিক্ষাব্যবস্থার সংকট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবনা তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক শোয়াইব আহমেদ বলেন, করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবে পুরো বিশ্ব কাটাচ্ছি ঘরবন্দী জীবন। পাড় হয়ে যাচ্ছে সৃষ্টিকর্তার বেঁধে দেয়া সময়। সবাই নিজ নিজ জায়গায় আটকা পড়ে আছে। অধিকাংশ মানুষ কর্মহীন বেকার হয়ে গেছেন। আবার যারা কর্মক্ষেত্র চলমান তাদেরও নিজেদেরকে চরম ঝুঁকির মধ্যে রেখে চালিয়ে যেতে হচ্ছে কাজ। এইরকম বিষাদময় সময়ে শিক্ষার্থীরাও কোণঠাসা অবস্থায় অলসভাবে অতিবাহিত করছে তাদের পড়াশোনার প্রকৃত সময়টুকু। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও নিজেদের সন্তানদের নিয়ে রয়েছে চিন্তিত। কেউই জানে না কবে আবার সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে, শিক্ষার্থীরা আবার তাদের সাধারণ নিয়মে শুরু করবে তাদের পড়াশোনা। করুণ এই অবস্থায় অনেক বেসরকারি ও কিছু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অল্প পরিসরে চালু করেছে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম কিন্তু তাতে একদিকে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে যেমনি সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না তেমনি আবার স্বল্প সময়ের মধ্যে ক্লাস নেয়া এবং ক্লাসের সংখ্যা কম থাকায় পুরো সিলেবাস শেষ করার ব্যাপারেও সন্দিহান শিক্ষকরা। এই অবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সম্মিলিত উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। দেশের সিম অপারেটিং কোম্পানিগুলোর সাথে কথা বলে শিক্ষার্থীদের জন্যে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে চাহিদা মতো ইন্টারনেট সেবা এবং অভিভাবকদের উচিত নিজেদের উদ্যোগে নিয়মিত তাদের সন্তানদের পড়তে অভ্যস্ত করা এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যাতে কোনোভাবেই অলস দুষ্টুমি আর খেলার ছলে বিপদে চলে না যায় তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আসমা আলী মীম বলেন, বিশ্বে উদ্ভট করোনা (কোভিড-১৯) ভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে চরম সংকট। শিক্ষা ব্যবস্থা ও তার ব্যতিক্রম নয়। এ পরিস্থিতিতে গত ১৬ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ এবং এর কিছু দিন পর থেকেই সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ধাপে ধাপে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। গত ২৭ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ব্রিফিংয়ে জানান, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বন্ধ রাখা হবে।’ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে সকল স্কুলগুলোতে বোর্ড পরীক্ষার আসন বিন্যাস করা হয়, সে সকল স্কুলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা চলতি বছরে জানুয়ারী মাস ব্যতীত ক্লাস করার সুযোগ পায়নি বললেই চলে। কেননা গত ফেব্রুয়ারি মাসে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে সে সকল স্কুলের অন্যান্য ক্লাস, পরীক্ষাগুলো বন্ধ ছিল। অন্যদিকে গত পহেলা এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও করোনা ভাইরাসের কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে, যা এখনো পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সেশনজটে পড়ার বড় আশঙ্কায় আছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে বলে আমি মনে করি। দীর্ঘদিনের এই ক্ষতি কিভাবে পোষানো হবে তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস করালেও বেশিরভাগ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক সুবিধার অভাবে ক্লাস করাতে পারছে নাহ। এখন পর্যন্ত সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার আর কিছু প্রতিষ্ঠানের অনলাইনে পড়াশোনা ছাড়া ক্ষতি পোষানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই নেই। শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে না বলে জানিয়েছেন। এমতাবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীদের উচিত হবে বাসায় বসেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পড়াশোনার বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর মাধ্যমে নিজেকে এগিয়ে রাখা যাতে এই ক্লান্তিলগ্ন শেষ হওয়ার পরপরই আমরা এই অবস্থা থেকে উওরন করতে পারি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হোসনে সাদিয়া নিতু বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারাবিশ্ব আজ চরম বিপর্যস্থ। সারাবিশ্ব বর্তমানে লকডাউনে। বিশ্বের অর্থনীতি আজ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ এবং হুমকির মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষাখাত ও চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি অবস্থান করছে। সারাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন মুখথুবড়ে পড়েছে। গত প্রায় তিনমাস যাবৎ দেশের সকল স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এতে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর লেখাপড়া চরম সংকটের মধ্যে পড়েছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ পাবলিক পরীক্ষা এইচএসসি ফাইনাল স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু কখন এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এই মুহূর্তে তা বলাও সম্ভব নয়। ফলে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। নতুন প্রজন্মের জন্য এটি একটি চরম ধাক্কা। অনেকের কঠোর পরিশ্রমে করা পরীক্ষার প্রস্তুতি জলাঞ্জলি দিতে হলো। ভাইরাসের ফলে দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং সকল পরীক্ষা স্থগিতের ফলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিতের ফলে শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছেন। এমনও শিক্ষার্থী আছে যাদের একটি বা দুইটি পরীক্ষা বাকি ছিল তারাও আটকা পড়ে রয়েছেন। আদৌও কখন সেই পরীক্ষা হবে সেটি কেউ জানেনা। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অনলাইনে ক্লাস নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও তা বিভিন্ন সমস্যার কারনে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে ব্যপকভাবে তলানিতে পড়ে গেছে শিক্ষাব্যবস্থা। আবার দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কারোরই খুব বেশি ভাবতে দেখা যাচ্ছে না। করোনা ভাইরাসের বিপরীতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল রাখতে হলে বিকল্প পদ্ধতি এখনই অবলম্বন করা প্রয়োজন। নতুবা আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আরও তলানিতে অবস্থান করতে পারে।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী নাসরিন রিয়া বলেন, করোনা মহামারীতে শিক্ষাব্যাবস্থা চরম সংকটে। মাসের পর মাস বন্ধ পড়ে আছে স্কুল,কলেজসহ সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলো। এই অনির্দিষ্টকালের বন্ধে ঘরে বন্দী জীবন কাটাচ্ছে শিক্ষার্থীরা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। সব থেকে বেশী কোনঠাসা হয়ে আছে ২০২০ ব্যাচের এইসএসসি পরীক্ষার্থীরা, কবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে নেই কোনো প্রকার নিশ্চয়তা। আতংকিত হয়ে কাটাচ্ছে এই অনির্দিষ্টকালের অবকাশ। এরই মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে, নেটওয়ার্কিং ব্যাবস্থার শোচনীয় অবস্থার জন্য অনেক শিক্ষার্থীই পাঠদান হতে বঞ্চিত হচ্ছে।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী এস আহমেদ ফাহিম বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এবং ভর্তি পরীক্ষা গুলো পিছিয়ে যাবে এবং কবে হবে তাও অনিশ্চিত। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে দুশ্চিন্তা। দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস শুরু হলেও সব শিক্ষার্থীরা এতে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। দীর্ঘসময় এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে এবং পুনরায় তা চলমান করতে শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে বলে আমি মনে করি।
মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপশিক্ষার্থী ও সাংবাদিকজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়০১৭৭৫৬৯৯২১৯