► পশু বিক্রি ২৫ শতাংশ আর দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে
► দেশের সাড়ে পাঁচ লাখ খামারি ও প্রান্তিক কৃষকরা শঙ্কায়
► বাড়তে পারে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে মুসলমানদের আরেকটি বড় ধর্মীয় উৎসব আসন্ন। এক মাস পরই ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদ্‌যাপিত হবে। দেশে করোনা সংক্রমণের ১১২ দিন পার হয়েছে এরই মধ্যে। সংক্রমণ বাড়ছে। করোনার কারণে একদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, অন্যদিকে বেড়েছে কোরবানির যোগ্য পশুর উৎপাদন। সংক্রমণ বাড়ায় হাটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে ক্রেতারা। তাই ঠিকমতো হাট জমবে কি না তা নিয়ে রয়েছে ব্যবসায়ীদের সংশয়। ফলে উৎপাদিত পশু বিক্রি করে সারা বছরের বিনিয়োগ ফিরে পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে খামারি থেকে শুরু করে পশুপালনকারী প্রান্তিক কৃষক সবাই।

করোনা সংক্রমণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী কোরবানি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নির্দেশনা জারির প্রস্তুতি নিচ্ছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। এর আগে ঈদুল ফিতরেও নামাজ আদায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।

পশুর হাটে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে।

রাজধানীতে কোরবানির পশু জবাইয়ের কাজে জড়িত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় দুই লাখ লোক আসত। এবার এখনো চাহিদা পাওয়া যায়নি। ফলে যাঁরা কসাই ভাড়া করেন তাঁরা বলছেন, এবার না আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের ধারণা, এবার কোরবানি কম হতে পারে।

বিভিন্ন পক্ষের হিসাবে এবার কোরবানির পশু বিক্রি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। এ ছাড়া দাম কমতে পারে ২০ শতাংশ পর্যন্ত।

উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার কারণে আয় কমেছে সব শ্রেণির মানুষেরই। দৈনন্দিন জীবন ধারণের ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্তরাও। এ ছাড়া যাদের সামর্থ্য আছে তারাও ঝুঁকি নিয়ে কতটা হাটে আসবে তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। তাঁরা বলছেন, গত বছর থেকে কোরবানিযোগ্য পশুর পরিমাণ বেড়েছে। তার সঙ্গে যোগ হবে গত কয়েক মাস মাংসের চাহিদা কমে আসায় উদ্বৃত্ত পশু। ফলে চাহিদা কমে গেলে দামও কমে আসবে। করোনার কারণে বাড়তি খরচ দিয়ে পশু পালনকারী কৃষক ও খামারিরা তাই রয়েছে লোকসান আতঙ্কে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত বছর কোরবানিযোগ্য গবাদি পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৮ লাখ। কোরবানিতে পশু জবাই করা হয়েছিল এক কোটি ছয় লাখ। ১০ লাখের বেশি পশুর জোগান বেশি ছিল চাহিদা থেকে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এবার এক কোটি ২০ লাখ কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। এর মধ্যে শুধু গরুই রয়েছে ৬০ লাখ, যা গত বছর ছিল ৪৫ লাখ। সারা দেশে এই মুহূর্তে পাঁচ লাখ ২২ হাজার গবাদি পশুর খামার রয়েছে।

খামারিরা বলছেন, উদ্বৃত্ত পশু যোগ করলে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা এবার আরো বেশি হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান কালের কণ্ঠকে বলেন, গত তিন মাসে মাংস বিক্রি কমে যাওয়ায় ৩০ শতাংশ পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। তার ওপর যোগ হবে কোরবানি লক্ষ্য করে উৎপাদিত পশু। সব মিলিয়ে এবার দেশে চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত থাকবে। বিপরীতে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কম। ফলে যে দুই লাখ টাকার গরু কিনত সে এক লাখ টাকার গরু খুঁজবে। যে দুটি কিনত সে একটা কিনবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা, এবার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ গরু কম বিক্রি হবে। আর চাহিদা কমে জোগান বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই দামও কমে আসে। সুতরাং খামারি ও কৃষকদের দুই দিক থেকেই লোকসান।’

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপ বলছে, গত মার্চের শেষের দিকে সাধারণ ছুটির পর দেশে ৯৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। জরিপে দেখা গেছে, সাধারণ ছুটির আগে যাদের মাসিক গড় আয় ছিল ২৪ হাজার ৫৬৫ টাকা, গত মে মাস থেকে তা কমে সাত হাজার ৯৬ টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ আয় কমেছে ৭৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলের মানুষের আয় কমেছে বেশি। গ্রামাঞ্চলের মানুষের আয় কমেছে ৭৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের মানুষের আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। এ ছাড়া বৈশ্বিক মন্দায় প্রবাসীরা দলে দলে দেশে ফিরে আসছেন। যাঁরা বিদেশে আছেন তাঁরাও রয়েছেন টানাটানির মধ্যে। এসবের প্রভাব পড়বে কোরবানির পশুর বাজারে।

জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, গত তিন মাস মাংসের ভোগ কম হয়েছে। এতে পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। তার ওপর প্রতিবছর ১০ শতাংশ করে বাড়ে পশুর পরিমাণ। খারাপ আর্থিক অবস্থার প্রভাব থাকবে কোরবানিতেও। আগের মতো মানুষ আর কোরবানির পশু কিনতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে, ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কোরবানি কম হবে এবার। চাহিদার তুলনায় পশু বেশি থাকায় এবার দামও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমে আসবে। এটা খামারি ও প্রান্তিক কৃষকের জন্য খুবই খারাপ অবস্থা। তারা সারা বছর গরুর পেছনে শ্রম দিয়ে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা আয় করে। এবার হয়তো লোকসান দিতে হবে।’

তবে করোনার কারণে হাটে না যাওয়ার প্রবণতায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বাড়তে পারে বলেও ধারণা করছেন ড. জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া বাজার জমে না, এটা ঠিক। কিন্তু সরকারের খেয়াল রাখতে হবে যেন তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে।’

এবার এখন পর্যন্ত রাজধানীতে অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা নিয়েও দ্বিধায় রয়েছেন আগ্রহী ইজারাদাররা। তাঁরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে আর্থিক মন্দা চলছে, সেখানে বিনিয়োগ করে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি না সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। ঢাকা উত্তরের ১০টি হাটের মধ্যে চারটির ইজারা সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বারের চেষ্টায়ও দর কম পাওয়ায় বাকি ছয়টির ইজারা সম্পন্ন হয়নি। অন্যদিকে পশু ব্যবসায়ীরা বলছেন, দূর-দূরান্ত থেকে গরু এনে বিক্রি করতে না পারলে বড় লোকসান হয়ে যাবে।

জানা যায়, সব কিছু বন্ধ থাকায় গো খাদ্যের দামও চড়া। তার ওপর রয়েছে শ্রমিক সংকট। ফলে পশু পালনেও খরচ বেড়েছে আগের তুলনায়। এক মাস আগে এক বস্তা (৩৭ কেজি) গমের ভুসির দাম ছিল ১১ শ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৪ শ টাকা। শুধু গমের ভুসি নয়, সব গো খাদ্যের দাম গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। পরিবহন সংকটে গো খাদ্যের অভাবও দেখা দিয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দেশ মাংসের চাহিদায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পর থেকে ভারতীয় গরু আসা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। আগে সারা বছরে ২০ থেকে ২৫ লাখ ভারতীয় গরু আসত। গত বছর সেটা এক লাখের নিচে নেমে এসেছে। এর একটি বড় অংশ এসেছিল কোরবানির ঈদের সময়।