ঢাকা, ২৭ জুন- একটি শপিং মলের কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন হুমায়ন কবির। বিয়ে করেছেন চার বছর হলো। স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। যদিও ব্যাচেলর হিসেবে ঢাকা শহরে তার বসবাস ১৩ বছর আগ থেকে। করোনায় চাকরি হারিয়ে রীতিমতো নিঃস্ব তিনি। চাকরি হারানোর পরে আয়-উপার্জনের ভিন্ন পথ খুঁজেও তিনি ব্যর্থ হন।

সব পথ হারিয়ে ভাগ্যকে মেনে নিয়েই এই জীবিকার শহর ছেড়ে তিনি আজ (শনিবার) নিজ এলাকা নাটোরে চলে যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে হুমায়ন কবির বললেন, ‘চলে যাচ্ছি, এই শহর আর আমার হলো না’।

তিনি বলেন, ‘চাকরি হারানোর পর আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে, নতুন আয়ের পথ সৃষ্টি করতে চেষ্টাও করেছিলাম। একটি ভ্যান ভাড়া নিয়ে কারওয়ান বাজার থেকে সবজি কিনে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করেছি কয়েকদিন। কিন্তু ভ্যান ভাড়া, সব খরচ বাদ দিয়ে ইনকাম বেশি থাকত না, ক্রেতাও কম। যে কারণে ওটা করেও আর পোষাতে পারিনি। তাই সব ধরনের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়েই ঢাকা ছেড়ে নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি আমরা।’

টিউশনি করে স্ত্রী ও এক কন্যা নিয়ে সংসার চলতো জাকারিয়া লাবণের। বনশ্রী থেকে গত বুধবার তিনি রাজধানী ছেড়ে জামালপুরের মাদারগঞ্জে চলে গেছেন। যাওয়ার সময় তিনটি ছবি তার ফেসবুক ওয়ালে দিয়ে তিনি লিখেন, ‘এই শহরে চার বছর ধরে তিলে তিলে গড়া সংসারটা মাত্র একটা ট্রাকে করে নিয়ে নিরুদ্দেশ হলাম। বাকিটা আল্লাহ দেখবেন। শুভ কামনা সকলের তরে। মায়ার এই শহর আর কারও সাথে বেঈমানি না করুক।’

শুধু হুমায়ন কবির আর জাকারিয়া লাবণই নন, করোনার পরিস্থিতির কারণে চাকরি বা ব্যবসা হারিয়ে অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। চলে যেতে হচ্ছে আরও অনেককে। ঢাকায় তাদের এখন আর কোনো কাজ নেই, বেতন নেই, আগের মতো ব্যবসাও নেই। তাই যেন তাদের আশ্রয়ও নেই এখানে। যে কারণে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তারা।


ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ব্র্যাক মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোকের চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ।

রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা জামাল আক্তার। একটি বেসকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। কিন্তু করোনার কারণে তিনি ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না কয়েক মাস ধরে। মাঝে দুই-একবার পেলেও তা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

জামাল আক্তার বলেন, ‘চাকরির বেতনের ওপর পুরাপুরি নির্ভর করে আমার সংসার চলত। যেখানে শুধু বাসা ভাড়াই দিতাম ১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া সংসার চালানোর জন্য খরচ হত বাকিটা, কোনো সঞ্চয়ই ছিল না। খেয়ে-পড়ে সব শেষ। কিন্তু আমার এই স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ঘটে যায় করোনার কারণে। ঠিকমতো বাসা ভাড়া দিতে পারিনি দুই মাস। ঠিকমতো বেতনও পাই না। আয়ের অন্য কোনও পথও নেই। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের চলে যেতে হচ্ছে ঢাকা ছেড়ে।’

‘কখনও এমন ভাবিনি, আমাদের স্বাভাবিক জীবনে এমন ছন্দপতন ঘটবে। নিঃস্ব হয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমার পরিচিত একজন তার ঘরের ফার্নিচার, বাইসাইকেলসহ অনেক কিছু কম দামে বিক্রি করে,বাসা ভাড়া পরিশোধ করে চলতি মাসে ঢাকা ছেড়ে গেছে। দুই তিন দিনের মধ্যে আমরাও চলে যাচ্ছি। ১১ বছর ধরে ঢাকায় থাকি, কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতার কারণে এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।’

পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, রাজধানীর বাসিন্দাদের ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। যাদের মধ্যে অনেকেই এখন হারিয়েছেন চাকরি বা উপার্জনের পথ।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক হিসাবে দেখা যায়, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। সংগঠনটির অন্য এক হিসাব বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসা ভাড়ায়।

বেকার, ভাগ্যান্বেষী, বিদ্যান্বেষীসহ নানা শ্রেণির মানুষের ‘স্বপ্ন গড়ার শহর’ ঢাকা। সেজন্য দিন দিন এই নগরে মানুষ বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। কিন্তু গত মার্চে দেশে করোনাভাইরাস হানা দেয়ার পর সেই মানুষদের স্বপ্ন যেন ভাঙতে শুরু করেছে। গত ক’মাসে আয়-রোজগার কমে এমনকি কর্ম হারিয়ে বিপাকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। হতদরিদ্ররা হয়ে পড়েছেন আরও অসহায়। জীবিকার এমন সংকট দেখা দেয়ায় ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে রাজধানীতে লোকসংখ্যা ছিল ৬৮ লাখের সামান্য কিছু বেশি। কিন্তু ১৯৯১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে রাজধানীর লোকসংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টাসের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাসিন্দা ১ কোটি ৭০ লাখ।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০০৭ সালের পর খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা কারণে দেশের ভেতর উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ। এসব মানুষের অধিকাংশই কর্মের সন্ধানে ঢাকায় প্রবেশ করে। তবে করোনার ধাক্কায় এসব মানুষের জীবনে এখন বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে। বাধ্য হয়েই দুঃখ আর অসহায়ত্বকে সঙ্গী করে তাদের ছাড়তে হচ্ছে স্বপ্ন গড়ার শহর ঢাকাকে।

প্রায় ১৪৬৩.৬০ বর্গকিলোমিটারের এই ঢাকায় বাস করতে হয় প্রায় দুই কোটি মানুষকে। তাই তো মানুষকে উচ্চ ভাড়ায়, বলতে গেলে বেতনের বা আয়ের সিংহভাগ টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। বাসা ভাড়ার খড়্গ মানুষকে অর্থনৈতিক নির্যাতনের মুখে ফেলছে প্রতিনিয়ত। করোনায় রাজধানী ঢাকার এখন প্রায় সব এলাকার বাসায় বাসায় ঝুলছে ‘টু লেট’। কয়েকমাস ধরে নতুন করে আশানুরূপ ভাড়াটিয়া পাচ্ছে না বাসার মালিকরা।

মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে। অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছে। তবে অতি ধনির অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। এমন তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।

এসব বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অনেকেরই আয় কমেছে। এই অবস্থায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করা অনেকেরই জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা হলেও বাড়ি ভাড়া মওকুফ করার জন্য, কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছেন না। অনেক মানুষ বেকার এবং আয় কমে যাওয়ার কারণে তাদের পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আগে। কিন্তু এখন আবার সংকট তীব্র হওয়ায় অনেকেই ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এর সহজ প্রমাণ হলো প্রতিটি অলি, গলির প্রায় সব বাসাতেই টু লেট দেখা যাচ্ছে। গত দুই তিন মাস ধরে বাসাগুলো ফাঁকা।