ইমদাদুল হক মিলন
হুমায়ূন আহমেদ এক কিংবদন্তি। সাহিত্যে তাঁর জনপ্রিয়তার তুলনা চলে শুধু শরত্চন্দ্রের সঙ্গে। শরত্চন্দ্রকে বলা হয় অমর কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদও অমর কথাসাহিত্যিকই। মৃত্যুর পর যে লেখকের জনপ্রিয়তা কমে না বরং বেড়েই চলে, সাহিত্যে তিনি স্থায়ী হয়ে যান। হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী হয়ে গেছেন
হুমায়ূন আহমেদ এক কিংবদন্তি। সাহিত্যে তাঁর জনপ্রিয়তার তুলনা চলে শুধু শরত্চন্দ্রের সঙ্গে। শরত্চন্দ্রকে বলা হয় অমর কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদও অমর কথাসাহিত্যিকই। মৃত্যুর পর যে লেখকের জনপ্রিয়তা কমে না বরং বেড়েই চলে, সাহিত্যে তিনি স্থায়ী হয়ে যান। হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী হয়ে গেছেন। তিনি চলে গেছেন আট বছর হলো। বইমেলায় এখনো তাঁর বইয়ের বিক্রি তুঙ্গে। তাঁর ধারেকাছেও নেই কারো জনপ্রিয়তা। তাঁর পুরনো নাটকগুলো দেখার জন্য এখনো দর্শক নাওয়া-খাওয়া ভুলে বসে থাকে টেলিভিশনের সামনে। কমেনি তাঁর সিনেমাগুলোর আকর্ষণ। কমেনি তাঁর রচিত গানগুলোর আকর্ষণ। সব কিছু মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এক মহা জাদুকর। তাঁর কলম ছিল আসলে জাদুর কাঠি। সেই জাদুতে আরো বহু বহু কাল বাঙালি পাঠক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকবে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকবে টিভি নাটকের দর্শক, সিনেমার দর্শক। গভীর রাতে প্রেমে পড়া যুবক ঘুম ভেঙে শুনবে ‘এক যে আছে সোনার কন্যা’ গানটি।
কিন্তু ব্যক্তিজীবনে কেমন ছিলেন এই জাদুকর? আপাত গম্ভীর রাগী চেহারার ছোটখাটো মানুষটি ছিলেন রসে টইটম্বুর। তাঁর শিল্পবোধের যেমন তুলনা নেই, রসবোধেরও তুলনা ছিল না। কবি নির্মলেন্দু গুণ একবার তাঁর এলাকা থেকে ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিলেন। দুজনেই কাছাকাছি এলাকার লোক। নির্মলদার প্রতীক ছিল কুমির। হুমায়ূন ভাইকে নিয়ে গেছেন প্রচারণায়। ফিরে আসার পর হুমায়ূন আহমেদের অনুজপ্রতিম লেখক বন্ধু তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘নির্মলদার অবস্থা কী?’ তিনি সিগ্রেটে টান দিয়ে নির্বিকার গলায় বললেন, ‘ফেলটা কনফার্ম করে দিয়ে আসছি।’ পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশক ও বন্ধু আলমগীর রহমানদের রাজকীয় বাড়ি। ছুটির দিন সন্ধ্যায় প্রায়ই সেই বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতে যেতেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রিয় মানুষদের খাওয়াতে ভালোবাসেন আলমগীর ভাই। কিছু কিছু আইটেম অসামান্য রান্না করেন তিনি। ওরকম এক বিকেলে হুমায়ূন ভাইয়ের আসতে দেরি হলো। মুখে-চোখে বিরক্তি। কী কারণ? বললেন, সেলুনে ঢুকেছিলেন চুল কাটাতে। চুল কাটবার আগে নাপিত নাকি তাঁর নাকের লোম কাটবার জন্য নাকে কাঁচি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এই কারণে তিনি চুল না কাটিয়ে চলে এসেছেন। কিন্তু চুল আজ তাঁর কাটাতেই হবে।
এক প্রকাশককে অ্যাভয়েড করার জন্য বললেন, দশ লাখ টাকা অ্যাডভান্স দিতে হবে। নব্বইয়ের দশকে দশ লাখ অনেক টাকা। সেই প্রকাশক পঞ্চাশ-একশো টাকার বান্ডেল মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে চমকে দেওয়ার জন্য বস্তা ভরে সেই টাকা নিয়ে তাঁর হাতে দিয়ে এলেন। হুমায়ূন ভাই স্তম্ভিত
আলমগীর ভাই ব্যবস্থা করলেন। তাঁর কাজের লোক গিয়ে পাড়ার সেলুন থেকে নাপিত ডেকে আনল। আলমগীর ভাইদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে শিশুর ভঙ্গিতে বসলেন হুমায়ূন ভাই। নরসুন্দর তাঁর চুল কাটতে লাগল। ওই অবস্থায় তাঁর হাতে সিগ্রেট। তার পর থেকে তিনি জীবনে আর কোনো দিন সেলুনে চুল কাটাতে যাননি।
চুরাশি সালের শেষ দিকে একদিন সকাল থেকে তাঁর অনুজপ্রতিম লেখক বন্ধুকে নিয়ে বাংলাবাজারের প্রকাশকের দোকানে বসে আছেন। প্রকাশক বলেছেন, দুজনকেই টাকা দেবেন। দুপুর গড়িয়ে যায়, তিনি আসেন না। দুজন লেখকেরই আর্থিক অবস্থা খারাপ। পকেটে দশ-বিশ টাকার বেশি নেই একজনেরও। ওই দিয়ে কোনো রকমে দুপুরের খাবার সারলেন। তারপর আবারও অপেক্ষা। প্রকাশক ভদ্রলোক এলেন শেষ বিকেলে। ভালো খাওয়াদাওয়া করে ঘুম দিয়েছেন। মুখে আদুরে ভাব। সেই মুখ করুণ করার চেষ্টা করে বললেন, ‘বই একদমই বিক্রি হয় না। আপনাদের টাকা দেব কোত্থেকে?’ ঘটনা মোটেই সত্য না। তখন বলতে গেলে প্রতিদিনই হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। প্রকাশকের কথা শুনে দুজন লেখকই ম্লান হয়ে গেলেন। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর অনুজপ্রতিম বন্ধুকে বললেন, ‘আমার কাছে এখনো দশ-পনেরো টাকা আছে। তোমার কাছে আছে কত?’ সেই লেখকের পকেটেও দশ-বারো টাকা ছিল। অঙ্কটা জেনে তিনি বললেন, ‘চলো, প্রকাশক সাহেবকে গোটা বিশেক টাকা দিয়ে বলি, আপনার যখন এতই অভাব আর আমাদের বইও বিক্রি হয় না, নিন, এই টাকাটা দিয়ে কাল বাজার করে খান। অন্তত এক দিন তো চলতে পারবেন।’
তখন নিয়মিত আড্ডা দিতেন বাংলাবাজারের নওরোজ সাহিত্য সংসদে। সেই আড্ডায় অনুজপ্রতিম লেখক বন্ধুটি তো থাকতেনই, আর থাকতেন বিখ্যাত সাংবাদিক হেদায়েত হোসাইন মোর্শেদ। রয়ালটি তখনো তেমন আসতে শুরু করেনি। তার পরও একদিন কিছু টাকা পেলেন। তখন থাকেন আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিম দিককার গলির বাসায়। লেখক বন্ধুটিকে নিয়ে রওনা দিলেন। তাঁর বাসায় গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটি ক্লাবে যাবেন আড্ডা দিতে। সেখানে থাকবেন হুমায়ুন আজাদ ও সালেহ চৌধুরী। চা-শিঙাড়া খাওয়া হবে আর গল্প আড্ডা। সালেহ ভাই গল্প শুরু করতে গেলেই হুমায়ুন আজাদ বলবেন, ‘আপনার গল্পগুলো অযথা লম্বা। লম্বা করবেন না।’ সালেহ ভাই তবু দমবেন না, গল্প চালিয়েই যাবেন। হুমায়ূন আহমেদ আর অনুজ লেখকটি সিগ্রেট টানবেন আর চা খাবেন। কথা বলবেন না।
সেদিন শচারেক টাকা রয়ালটি পেয়েছিলেন হুমায়ূন ভাই। রিকশা করে যাচ্ছেন দুজনে। বাহাদুর শাহ পার্কের ওখানে দেখা গেল একজন পাখিওয়ালা পাখি বিক্রি করছে। হুমায়ূন আহমেদ লাফ দিয়ে নামলেন। খাঁচাসহ দেড়শো টাকা দিয়ে গোটা আষ্টেক মুনিয়া পাখি কিনে ফেললেন। গভীর আনন্দে পাখির খাঁচা কোলে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। মুনিয়ার বিষ্ঠায় তাঁর শার্টে চিরিক-পিরিক দাগ পড়েছে।
ভারতীয় হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন একজনের সঙ্গে সালেহ চৌধুরীর খুব বন্ধুত্ব ছিল। সেই ভদ্রলোক শামসুর রাহমানের ভক্ত। শামসুর রাহমানকে নিয়ে তাঁর ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে আড্ডা হতো। আড্ডায় হুমায়ুন আজাদ, সালেহ চৌধুরীর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর অনুজ লেখকটিও থাকতেন। পানাহার চলত। হুমায়ূন আহমেদ ওসবের মধ্যে নেই। কথাও তেমন বলেন না। শুধু শোনেন আর ফুকফুক করে সিগ্রেট টানেন। এসবের বহু বহু বছর পর হুমায়ূন আহমেদ আর তাঁর মায়ের একই সঙ্গে ওপেন হার্ট হলো সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে। মায়ের পাওয়া গেল নয়টি ব্লক, হুমায়ূন ভাইয়ের এগারোটি। ডাক্তার তাঁকে বললেন, দুই গ্লাস করে রেড ওয়াইন খাবেন। ওটা হার্টের জন্য ভালো। হুমায়ূন ভাই কখনো কখনো পুরো এক বোতল রেড ওয়াইন খেয়ে ফেলতেন।
যে প্রকাশকরা দু-চারশো টাকা দিতে গড়িমসি করতেন তাঁদেরই একজন ঝকঝকে নতুন সুবারু গাড়ি কিনে সেই গাড়ির চাবি দিয়ে এলেন হুমায়ূন আহমেদের হাতে। রয়ালটি থেকে অ্যাডজাস্ট হবে। এক প্রকাশককে বই দেওয়ার কথা বলে দিতে পারেননি। সেই দুঃখে প্রকাশক পাগলপ্রায়। তাঁর ডায়াবেটিস হয়ে গেল। এক প্রকাশককে অ্যাভয়েড করার জন্য বললেন, দশ লাখ টাকা অ্যাডভান্স দিতে হবে। নব্বইয়ের দশকে দশ লাখ অনেক টাকা। সেই প্রকাশক পঞ্চাশ-একশো টাকার বান্ডেল মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে চমকে দেওয়ার জন্য বস্তা ভরে সেই টাকা নিয়ে তাঁর হাতে দিয়ে এলেন। হুমায়ূন ভাই স্তম্ভিত। মনে পড়েছিল একটি অলৌকিক ঘটনা। তাঁর তিন কন্যাই তখন ছোট। একেবারেই শিশু। স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে গেছেন আজমির শরিফে। ছোট কন্যাটিকে বলেছেন, এই মাজারে তুমি যা চাবে তাই পাবে। মাজার জিয়ারত করে ফেরার সময় দেখেন, ছোট মেয়েটি মাজারের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বস্তা বস্তা টাকা চায়। টাকা না নিয়ে ফিরবে না।
সত্যিকার অর্থেই প্রকাশকরা বস্তা বস্তা টাকা হুমায়ূন ভাইকে দিয়েছেন। ধানমণ্ডিতে বাড়ি করেছেন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বাংলো করেছেন। গড়ে তুলেছেন বিশাল নুহাশপল্লী। দুহাতে টাকা খরচ করতেন। সদলবলে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন। অনুজপ্রতিম বন্ধুটিকে একবার বলেছিলেন, ‘সিনেমা তৈরি আমার নেশা। আমার সিনেমায় তো টাকা ওঠে না। এ পর্যন্ত আট কোটি টাকা লস করেছি।’
একবার দলবল নিয়ে নেপাল বেড়াতে গেছেন। বিশাল এক শপিং মলে ঘুরছেন। অনুজ বন্ধুটিকে বললেন, ‘তোমার তো জামা-কাপড়ের শখ। একটা শার্ট কিনো, আমি পে করব।’ সেই বন্ধু একটা শার্ট পছন্দ করলেন, দাম চার হাজার রুপি। শুনে দিলেন এক ধমক। চারশো টাকার বেশি দিয়ে কিনতে পারবে না। বন্ধুটি মন খারাপ করে আর কিনলেনই না। হোটেলে ফিরে সেই বন্ধুর হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন হুমায়ূন ভাই। ব্যাগে চার হাজার রুপির সেই শার্ট।
‘ম্যাজিক মুনশি’ নামে তাঁর একটা বই আছে। ম্যাজিকে তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। বন্ধুদের নিয়ে আমেরিকায় বেড়াতে গেছেন। একটি পুরো সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলেন ম্যাজিক শপে। দেড়-দু হাজার ডলারের ম্যাজিক দেখাবার জিনিসপত্র কিনলেন। বন্ধুদের আড্ডায় ছোটখাটো ম্যাজিক দেখিয়ে অবাক করতেন সবাইকে। আলমগীর রহমানের ছেলের জন্মদিনে বিশাল একটা মুখোশ পরে গিয়ে হাজির হলেন। মায়ের সঙ্গে ছিল অদ্ভুত বন্ধুত্ব। দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে পুব দিককার একটা রুমে থাকতেন মা। মা বসে আছেন খাটে। ছেলে হুমায়ূন আহমেদ মেঝেতে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করছেন মা-ছেলে। মা গেছেন অন্য ছেলের বাসায় বেড়াতে। আর সেই রুমে জমেছে হুমায়ূন আহমেদের সন্ধেকালীন আড্ডা। অনুজ বন্ধুটির ফেলে আসা জীবনের এক রাত্রিতে অনাহারে ঘুমাতে না পারার কষ্টের কাহিনি শুনে সেই বন্ধুর গলা জড়িয়ে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন।
বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে তিনি একদমই আগ্রহী ছিলেন না। তার পরও ‘জ্যোত্স্না ও জননীর গল্প’র প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করলেন অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলেন। বাংলাদেশ থেকে আছেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও জাফর ইকবাল। প্রকাশক চাইছিলেন হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু আসাদুজ্জামান নূর হবেন এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। হুমায়ূন ভাই বললেন, না। বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান, উপস্থাপক হবেন একজন লেখক। তিনি তাঁর সেই অনুজ লেখক বন্ধুকে দিলেন দায়িত্ব। অনুষ্ঠানে শাওন খালি গলায় গাইলেন মোহিনী চৌধুরীর সেই বিখ্যাত গান ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কতো প্রাণ হলো বলিদান। লেখা আছে অশ্রুজলে’। গান চলছে। হুমায়ূন আহমেদ উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন।
বিটিভিতে ‘এইসব দিনরাত্রি’ প্রচারিত হচ্ছে। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে যাওয়ার পথ খুলে গেছে হুমায়ূন আহমেদের। টিভির উঠতি নায়িকারা প্রেমপত্র লিখতে শুরু করেছে হুমায়ূন আহমেদকে। কোথায় বসে সেই সব চিঠি পড়বেন? দশটা-বারোটা চিঠি পকেটে নিয়ে চলে যেতেন পুরান ঢাকায় তাঁর অনুজ বন্ধুর ফ্ল্যাটে। সেখানে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই সব চিঠি পড়তেন। দু-পা চেয়ারে তুলে আসনপিঁড়ির ভঙ্গিতে বসার অভ্যাস। সামনে চায়ের কাপ, হাতে সিগ্রেট। কখনো পুরো কাপ চা শেষ করতেন না। বড়জোর দু কি তিন চুমুক। কিন্তু চা থাকতে হবে হাতের কাছে। সিগ্রেট থাকতে হবে। অ্যাশট্রের দরকার নেই। দু চুমুক খাওয়া চায়ের কাপই অ্যাশট্রে। লিখতে বসে চলে যেতেন অন্য এক জগতে। যেন গভীর ধ্যানে বসা এক মানুষ। অথবা ঘোরে থাকা, নিশি পাওয়া মানুষ। জগত্সংসার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঢুকে আছেন নিজের তৈরি শিল্পের জগতে। কোথাও আর কিছুই নেই।
স্বপ্ন ছিল ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস লিখবেন। সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। তবে দেশ পত্রিকায় তাঁর একটা রেকর্ড আছে। পর পর সাত বছর দেশ পুজো সংখ্যায় তিনি উপন্যাস লিখেছেন। এই ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের কোনো লেখকের নেই। রমাপদ চৌধুরীর লেখা তিনি খুব পছন্দ করতেন। রমাপদ চৌধুরী আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় পাতার সম্পাদক। অতি গম্ভীর ধরনের মানুষ। কথা কম বলেন। মুখে হাসি তাঁর দেখাই যায় না। কলকাতায় গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ গেছেন আনন্দবাজার অফিসে। খুব ইচ্ছা রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করবেন। নিজের ‘গল্পসমগ্র’ বইটা রমাপদর হাতে দিয়ে আসবেন। কাজটা তিনি করলেন। রমাপদ চৌধুরী বইটা রাখলেন, কোনো কথা বললেন না, হুমায়ূন ভাইকে বসতেও বললেন না। হুমায়ূন ভাই মন খারাপ করে ফিরে এলেন। মাস ছয়েক পর রমাপদ বাবুর একটা চিঠি পেলেন। সেই চিঠিতে হুমায়ূন আহমেদের গল্পগুলোর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। রমাপদ চৌধুরীর মতে, হুমায়ূন আহমেদের কোনো কোনো গল্প আন্তর্জাতিক মানের।
‘এশিয়ার জনপ্রিয় লেখক’—এ রকম শিরোনামে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে ডকুমেন্টারি করেছিল জাপানের জাতীয় প্রচার সংস্থা এনএসকে। মোটিভেশনাল কয়েকটি ধারাবাহিক তৈরি করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। যেমন—‘সবুজ ছায়া’ বা ‘সবুজ ছাতা’। এগুলো আমেরিকার জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটিতে রেফারেন্স হিসেবে পড়ানো হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তাঁর বই অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনের জনক তিনি। প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘তারা তিনজন’। শিশু-কিশোরদের লেখায়ও তাঁর তুলনা তিনি নিজে। কয়েকটি বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন। কুদ্দুস বয়াতির পেছন পেছন একদল শিশু-কিশোর ছুটছে। বয়াতির ভূমিকা হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। গান হচ্ছে ‘এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে’। ওরস্যালাইনের বিজ্ঞাপন করেছিলেন। তাতে সুজা খন্দকারের ‘ঘুঁটা’ শব্দটা দেশের মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। মাম পানির বিজ্ঞাপন করেছেন। ‘রংয়ের বাড়ই’ নামে ঈদ আনন্দমেলা করেছেন বিটিভিতে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে কেন—এই নিয়ে মিছিল হয়েছে ঢাকায়। যখন ‘রাজাকার’ শব্দটি বাংলাদেশে উচ্চারণ করা যায় না তখন বিটিভির নাটকে পাখির মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ‘তুই রাজাকার’। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণ নিয়ে তাঁর ভাই জাফর ইকবালের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। অনশন করলেন ইউনিভার্সিটি চত্বরে।
লালন শাহর চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন হাছন রাজাকে। রাধারমণ, উকিল মুন্সি—এইসব গীতিকবি ও ভাটি অঞ্চলের বহু হারিয়ে যাওয়া গান তুলে এনেছেন তাঁর নাটকে আর গল্প-উপন্যাসে। জনপ্রিয়তার শীর্ষে তুলে দিয়েছেন। যেমন ‘আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম’ অথবা ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’। বইমেলায় যেই স্টলে বসেছেন পাঠক-ক্রেতা ভেঙে পড়েছে সেখানে। অন্য স্টলে লোকজন নেই। দেখে বাংলা একাডেমির তখনকার ডিজি বিরক্ত। সেই স্টলে গিয়ে হুমায়ূন ভাইকে বললেন, ‘আপনার জন্য তো মেলা চালানো যাচ্ছে না।’
হুমায়ূন ভাই কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ বাড়ি চলে এলেন। ওদিকে হুমায়ূন ভাইয়ের পাঠক-প্রকাশকরা বিদ্রোহ করে বসেছেন। মেলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ডিজি সাহেব ছুটে গেলেন হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাটে। বহু রকম অনুরোধ করে ফিরিয়ে আনলেন হুমায়ূন আহমেদকে। রেগে গেলে হুমায়ূন আহমেদ ভয়ংকর। একটাই গাল দিতেন ‘খেতা পুড়ি’। কী অর্থ এই শব্দের কে জানে। কিন্তু রাগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতেন না।
খেতেন খুব কম। কিন্তু টেবিল ভর্তি খাবার থাকতে হবে। নানা রকমের মাছ, খাসির মাংসের বড় বড় টুকরো, গলদা চিংড়ি, রিঠা মাছ খেয়ে বলে দিতে পারতেন কাটার সময় মাছটা জ্যান্ত ছিল, না মরা। ভোজনরসিক বলতে যা বোঝায় তা-ই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আবৃত্তি করে যেতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ। নাটকে রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করতেন। অনেক বইয়ের নাম নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ থেকে। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রিয়তম লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণের ‘কিন্নর দল’ গল্পটির কথা প্রায়ই বলতেন। স্টিফেন কিংয়ের লেখা পছন্দ করতেন খুব। সেই লেখকের ‘অনরাইটিংস’ বইটা হাতের কাছে থাকত।
বিচিত্র বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতেন। ধর্ম দর্শন ইতিহাস বিজ্ঞান কী থাকত না তাঁর পাঠ তালিকায়। বাংলাবাজারে গেছেন এক বইয়ের দোকান উদ্বোধন করতে। মিলাদ পড়তে আসা মাওলানা সাহেব হুমায়ূন ভাইকে অনুরোধ করলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে একটি বই লিখতে। হুমায়ূন ভাই বলেছিলেন লিখবেন। ‘নবীজি’ নামে একটা চ্যাপ্টার লিখেছিলেন। বাকিটা লিখতে পারেননি।
আলমগীর রহমান তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করেন। তাঁদের ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা সংস্থা আছে। পাকিস্তান আমলে নাম ছিল ‘পাকিস্তান বুক কর্পোরেশন’। স্বাধীনতার পর নাম হলো ‘বাংলাদেশ বুক কর্পোরেশন’। আশির দশকের শেষ দিকে আলমগীর রহমানের ইচ্ছে হলো তিনি আলাদা করে প্রকাশনা সংস্থা করবেন। নানান ধরনের বই করবেন। প্রকাশনার নাম দিলেন ‘অবসর’ প্রকাশনী। মুনতাসীর মামুনের ইস্পাহানি কলোনির ফ্ল্যাটে এক বিকেলে মিটিং হলো। সেখানে বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী আছেন। শাহরিয়ার কবির, আলমগীর রহমান ও হুমায়ূন আহমেদ আছেন। হুমায়ূন ভাইয়ের অনুজপ্রতিম বন্ধুটিও আছেন। সিদ্ধান্ত হলো, হুমায়ূন আহমেদের বই দিয়েই যাত্রা শুরু করবে ‘অবসর’। হুমায়ূন ভাইকে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হলো। সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তার উল্টো দিককার সাদা অংশে হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন, ‘পাঁচ হাজার টাকা বুঝিয়া পাইলাম।’ দিন পনেরো খেটে অবসরের জন্য উপন্যাস লিখলেন। সেই উপন্যাসের নাম ‘দেবী’। দেবীর জয়জয়কার নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। সবাই জানেন, এই বই লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছিল। মঞ্চনাটক হয়েছে, সিনেমা হয়েছে। আর এই ‘দেবী’ উপন্যাসের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে অবতীর্ণ হয়েছে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র মিসির আলী। দেবীর পর মিসির আলীকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন ‘নিশীথিনী’। ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাসে প্রথম দেখা গেল হিমুকে। মিসির আলী ও হিমু এখন কোটি পাঠকের অন্তরে।
কলকাতার এক অনুষ্ঠানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সভাপতি, বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হুমায়ূন আহমেদকে। ইলিয়াস ভাই জনপ্রিয় সাহিত্যকে অবজ্ঞা করে বক্তৃতা দিলেন। বোঝা গেল যে তিনি প্রকারান্তরে হুমায়ূন আহমেদকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। ব্যাপারটা লক্ষ করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সভাপতির ভাষণে তিনি জনপ্রিয় সাহিত্যের পক্ষে অনেক কথা বললেন। পরদিন শুধু হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন তাঁদের বুধসন্ধ্যা ক্লাবে। হুমায়ূন আহমেদের একক গল্প পাঠ। হল ভর্তি লোকজন। হুমায়ূন ভাই তাঁর ‘আনন্দ বেদনার কাব্য’ গল্পটি পড়লেন। একসময় দেখা গেল, হলের বহু দর্শক-শ্রোতা চোখ মুছছেন।
নিজ গ্রামে স্কুল করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার নামে পাঠাগার করেছিলেন বহু আগে। উদ্বোধন করতে নিয়ে গিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ, সালেহ চৌধুরী আর তাঁর অনুজপ্রতিম সেই লেখক বন্ধুকে। কত মানুষকে কত রকমভাবে সাহায্য করতেন। ছিলেন গভীরভাবে প্রকৃতিপ্রেমিক। নুহাশপল্লীতে গড়ে তুলেছেন বিশাল ঔষধি বাগান। লুঙ্গি পরতেন বুকের কাছে গিঁট দিয়ে। দেখে অনেকের মনে হতো, সেই লুঙ্গি বুঝি খুলে পড়ে যাবে। গভীর বৃষ্টিতে আর পাগল করা জ্যোত্স্নায় হৃদয় উথালপাথাল করত তাঁর। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে আর কখনো দেখা হবে না বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া মাঠ প্রান্তর নদী, দেখা হবে না ফুলের ফুটে ওঠা, ঋতুর সঙ্গে বদলে যাওয়া পাতার রং। পাখির মধুর গান বাজবে না কানে আর অপরূপ জ্যোত্স্নায় ভেসে থাকা প্রান্তর দেখা হবে না। এই বেদনার কথা তিনি প্রায়ই বলতেন। সৃষ্টিকর্তা কেন মানুষকে এত কম আয়ু দিয়ে পাঠিয়েছেন! অথচ পৃথিবীর কত প্রাণী দুশো-তিনশো বছর ধরে বেঁচে থাকে। হায়রে মানুষ জন্ম!
নুহাশপল্লীর সবুজ ঘাসের মাঠে একজন মানুষকে আমি এখনো দেখতে পাই। পূর্ণিমা রাতের দ্বিতীয় প্রহর চলছে। পাখিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। গাছপালায় হা হা করছে হাওয়া। আকাশের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে ভরা চাঁদ। রুপোলি জ্যোত্স্নায় মায়াময় হয়ে আছে চারদিক। সেই জ্যোত্স্না ভেঙে একাকী একজন মানুষ ঘাসের মাঠে পায়চারি করছেন। বুকের কাছে গিঁট দেওয়া লুঙ্গি। হাফশার্টের বোতাম লাগাতে ভুলে গেছেন। হাত দুটো পেছনে। জ্যোত্স্না ভেঙে ভেঙে তিনি হাঁটছেন। বিড়বিড় করে প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর সেই কথা শুনতে পাচ্ছে চাঁদের আলো আর গাছের পাতারা, শুনতে পাচ্ছে নিশিরাতের হাওয়া আর পায়ের তলার ঘাস, শুনতে পাচ্ছে আকাশ আর মাটি, পাহাড় সমুদ্র আর অচেনা প্রান্তর। সেই মানুষটি হুমায়ূন আহমেদ।