দেশে সাত হাজারের বেশি ভাটায় পোড়ানো হয় দেড় হাজার কোটির বেশি ইট। এই বিপুলসংখ্যক ইট পোড়াতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ২০ হাজার লাখ টন কাঠ এবং সমপরিমাণ কয়লা। কয়লা ও কাঠ পোড়ানোর ফলে ৯০ লাখ টনের বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয়, যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে। এ থেকে রক্ষা পেতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে ইটের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। কিন্তু ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক শিল্প উৎপাদন ও বিকাশে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী, দামে সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব। এত উপকারী হওয়ার পরও ব্লক ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে না উদ্যোগ ও প্রচারের অভাবে।
জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ করেছে ২০১৩ সালে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনও করা হয়েছে। সংশোধনকৃত আইনে ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক কারখানাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। লাইসেন্স না নিয়েও কংক্রিট ব্লক কারখানা স্থাপনের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়ার বিধান রয়েছে। নতুন ইটভাটার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধও রেখেছে বেশির ভাগ জেলা। তবে বিদ্যমান সাত হাজারের বেশি ইটভাটার লাইসেন্স নবায়ন করা হচ্ছে। কংক্রিট ব্লক জনপ্রিয় করা বা সনাতন ইটভাটা বন্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেওয়া হয়নি।
ইটের বিকল্প ব্যবহার উৎসাহিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) তেমন কোনো ফলপ্রসূ কর্মসূচি নেই। সীমিত সামর্থ্যের কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও ব্লকশিল্পকে জনপ্রিয় করতে পারছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে জেলা পর্যায়ে এখনো কোনো ক্যাম্পেইনও পরিচালনা করা হয়নি বলে ক্ষুদ্র ব্লক উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন।
‘সুমন ইকো ব্রিকসের’ উদ্যোক্তা সুমন দেবনাথ বলেন, ‘মাত্র ২০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে আমি ব্লক তৈরির প্রকল্পটি শুরু করি। দুটি বহুতল ভবন আমি তৈরি করেছি। ব্লক উৎপাদন আর এটি সবার কাছে পরিচিত করার দুটি কাজই আমাকে করতে হয়। সরকারের দিক থেকে কোনো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয় না। তবে এইচবিআরআই থেকে দিকনির্দেশনা আমি পাচ্ছি।’
এইচবিআরআই সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছর থেকে শুরু করে প্রতিবছর ১০ শতাংশ ইটের উৎপাদন ও ব্যবহার কমিয়ে আনতে চায় তারা। সে হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে শতভাগ ব্লক ব্যবহারে যেতে চায়। এসডিজি অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ব্লক জনপ্রিয় করতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্যোক্তারা এই শিল্প বিকাশে কাজ করার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। শিল্পটি চালু করতে সবচেয়ে বড় বাধা দক্ষ কর্মীর অভাব। সে লক্ষ্যে একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে চায় সংস্থাটি।
এইচবিআরআইয়ের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ‘সনাতন ইটের জন্য মাটির সংস্থান করতে গিয়ে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের উর্বর ভূমি নষ্ট হচ্ছে। প্রতি বছর এক শতাংশ কৃষিজমি চলে যাচ্ছে। কার্বন নিঃসরণের জন্য পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক ব্যবহার করলে মাটির ক্ষতি হবে না, কার্বন নিঃসরণ হবে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্র অর্জন করতে হলে অবশ্যই সনাতন পদ্ধতির ইট তৈরি বন্ধ করতে হবে।’
কংক্রিট ব্লকের বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘কংক্রিট ব্লক দামে সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইটের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয় ব্লক। তাই ব্লক ব্যবহারের দিকে যাওয়া উচিত। হলো ব্লক, সলিড ব্লক, থার্মাল ব্লকসহ বেশ কয়েকটি ব্লকের ব্যবহার বাড়ছে বাংলাদেশে। এই ব্লক দামে আরো সস্তা করার জন্য গবেষণা চলমান রয়েছে।’
এইচবিআরআইয়ের প্রিন্সিপাল রিচার্স অফিসার মো. আকতার হোসেন সরকার বলেন, ‘ব্লক জনপ্রিয় করতে আমরা লিফলেট বিলি করছি। এ ছাড়া উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কাজ করছি। ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা শতভাগ ব্লব ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছি।’
জানা গেছে, এসডিজি অর্জনে ইটভাটা বন্ধ করার পরিকল্পনা সরকারের থাকলেও মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। নতুন ইটভাটার লাইসেন্স বন্ধ রাখা হলেও নবায়ন অব্যাহত রয়েছে বেশির ভাগ জেলায়। নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেড় বছর ধরে এই জেলায় দায়িত্ব পালন করছি আমি। নতুন ইটভাটার কোনো লাইসেন্স আমি দিইনি। তবে পুরনো ইটভাটার লাইসেন্স নবায়ন করা হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, সনাতন ইটভাটা কেবল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এর ফলে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। ইট তৈরিতে প্রতি বছর ১২৭ কোটি সিএফটি মাটি প্রয়োজন হয়। আইনে বিধি-নিষেধ থাকলেও কৃষিজমি, জলাশয় এবং নদী থেকেই নেওয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাটি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সরকার আইন করল। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আর ২০২৫ সালের মধ্যে সব ইটভাটা সরকার কতটুকু বন্ধ করতে পারবে তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে।’