ভোগান্তির কোনো অভিযোগ নেই। কর অঞ্চলে আয়করদাতাদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে এ বছর আয়কর মেলার আয়োজন করেনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে করদাতাদের সুবিধায় প্রতিটি কর অঞ্চলে মেলার মতো পরিবেশ বজায় রেখে আয়কর রিটার্ন জমাসহ রাজস্ব সেবা প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। মেলার সব সুযোগ-সুবিধাই পাওয়া যাচ্ছে কর অঞ্চলগুলোতে। করদাতাদের বিপুল উপস্থিতি থাকলেও ভোগান্তির কোনো অভিযোগ নেই। সহজেই করদাতারা আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারছে। কর অঞ্চল থেকে করদাতাদের দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সেবাও। এনবিআর কর আদায় ব্যবস্থা আরো সহজ করতেই অনলাইনে রিটার্ন জমা নেওয়ার কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে রাজধানীর কর অঞ্চল-৬-এ শুরু হয়েছে কার্যক্রম। রাজধানীর বেশ কয়েকটি কর অঞ্চল ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

মেলার আদলে সেবা
কর অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ কর অঞ্চলে মেলার আদলে আলাদা আলাদা বুথে রিটার্ন দাখিল, ই-টিআইএন নিবন্ধনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। করদাতা, সেবাগ্রহীতা ও কর্মকর্তাদের সংস্পর্শ এড়াতে করোনা প্রতিরোধী বুথ স্থাপন করা হয়েছে। করদাতাদের মাস্ক পরিধান ছাড়া সেবা দেওয়া হচ্ছে না।

বুথে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও সংক্রমণ রোধে মুখে মাস্ক পরে সেবা দিচ্ছেন। যেসব কর অঞ্চলে বুথ করার জায়গা নেই সেখানে প্রতিটি সার্কেলে কর তথ্য ও সেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কর অফিসগুলো থেকেই বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে রিটার্ন ফরম, চালান ফরম, আয়কর পরিপত্র ও নির্দেশিকা। আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া শেষ হলেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে।

সিসিটিভি ক্যামেরায় মনিটরিং
প্রতিটি কর অঞ্চলের কমিশনার নিজেই সিসিটিভি ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক মনিটর করছেন। বুথ পরিদর্শন ও সেবায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে তার তদারকি করছেন। আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া উপলক্ষে প্রতিটি কর অঞ্চল বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে, করা হয়েছে আলোকসজ্জাও।

কর অঞ্চল-১৩
সরেজমিনে গত বুধবার সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর কর অঞ্চল-১৩ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বুথে করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট দূরত্বে বুথগুলো করা হয়েছে। সব বুথে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে সেবা প্রদান করছেন। আয়কর রিটার্ন জমা দিতে আসা লোকজন বুথের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছেন। কর অঞ্চলের কর্মকর্তারা বলছেন, সকালে তুলনামূলক লোকজনের ভিড় কম থাকলেও বিকেলে প্রচুর ভিড় থাকে। সেবা নিতে আসা করদাতাদের অনেকে বুথের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আয়কর রিটার্ন ফরম নিচ্ছেন। এরপর কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় তা পূরণ করেছেন। আয়, ব্যয় ও সম্পদের হিসাবের পর কত টাকার কর হয়েছে, তা অনেক কর্মকর্তা হিসাব করে করদাতাদের বলে দিচ্ছেন। কোন ব্যাংকে গিয়ে কর জমা দিতে হবে, আশপাশে কোথায় কোন ব্যাংক আছে, সে পরামর্শও বুথে উপস্থিত কর্মকর্তারা করদাতাদের বলে দিচ্ছেন। আয়কর মেলার আদলে কর অঞ্চলগুলোতে করদাতারা পাচ্ছেন ওয়ানস্টপ সেবা। তবে কর অঞ্চলগুলো শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করলেও শারীরিক দূরত্ব একদমই মানা হচ্ছে না।

কর অঞ্চল-১৩-তে রিটার্ন জমা দিয়েছেন ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালের ইনডোর মেডিক্যাল অফিসার ডা. আয়েশা আক্তার। তিনি উচ্চকণ্ঠ বলেন, ‘প্রতিবার আয়কর মেলায় রিটার্ন জমা দিয়ে থাকি। তবে এবারই প্রথম কর অঞ্চলে রিটার্ন জমা দিয়েছি। মনে করেছিলাম মেলায় যেভাবে বুথের মাধ্যমে দ্রুত রিটার্ন জমা দিয়ে চলে আসা যায়, কর অঞ্চলে সে ব্যবস্থা থাকবে না। কিন্তু এখানে এসে আমার ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মাত্র তিন মিনিটেই রিটার্ন জমা দিয়ে চলে এলাম। আমার মনে হচ্ছে, মেলার চেয়ে কম সময়েই এখানে কাজ শেষ করা যাচ্ছে। কর্মকর্তারাও আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিচ্ছেন।’

এ কর অঞ্চলেই কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই দ্রুত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দিয়েছেন আইটি ফার্মে কর্মরত ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘এ বছর আমার আয় কম ও ব্যয় কম। তাই আয়করও কম। গত বছর আয়কর রিটার্ন দিয়েছি ১২ হাজার টাকার বেশি। এ বছর ১০ হাজার টাকা। আমার মতো বেসরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে সরকারের আয়কর রিটার্ন প্রদানে কিছু সুবিধা দেওয়া উচিত ছিল।’

রাবার হোল্ডিংস লিমিটেডের মহাখালী অফিসে কর্মরত মো. ইকরাম উল্লাহ বলেন, ‘প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন মেলায় জমা দিই, সেটাও ভালো ছিল। তবে এবার কর অঞ্চলে জমা দিয়ে বুঝলাম মেলার চেয়ে এখানেই ভালো।’

কর অঞ্চল-৬
কর অঞ্চল-৬-তে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির প্রবেশপথ থেকে শুরু করে পুরো কর অঞ্চল নান্দনিকভাবে সাজানো হয়েছে। রাজস্ব প্রদানে উৎসাহিত করতে কর অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন স্লোগান লেখা রং-বেরঙের প্ল্যাকার্ড, ব্যানার টানানো আছে। কর তথ্য ও সেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ভবনের ভেতরে মেলার মতো মানুষের ভিড়। কর্মকর্তারা বলছেন, শেষ দিকে আরো মানুষের ভিড় বাড়বে। কর অঞ্চল-৬-এ করদাতার সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ব্যাংকের সব কর্মকর্তারা এখানেই রিটার্ন জাম দেন। কর্মকর্তারা জানান, এখানে করদাতার সংখ্যা এক লাখ ৩৫ হাজার। চাপ বেশি থাকার কারণেই অনলাইনে রিটার্ন জমা নেওয়া হচ্ছে। রিটার্ন জমা দিয়েছেন আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত রাজন দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘আমি এবারই প্রথম আয়কর জমা দিচ্ছি। তেমন কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। তবে অনলাইন এন্ট্রি করে জমার ক্ষেত্রে কিছু সময় লেগে যাচ্ছে।’

এনসিসি ব্যাংকের কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এত ভিড় হবে ভাবিনি। বেশ কিছু সময় লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দিলেও কোনো রকম হয়রানির শিকার হতে হয়নি। করোনায় আমাদের আয়-ব্যয়ের পার্থক্য না থাকায় আয়কর রিটার্ন গতবারের মতোই ছিল।’

সুমিতা পাল একজন আইনজীবী। তিনি তিনজনের রিটার্ন জমা দিতে এসেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকেই আয়কর রিটার্ন জমাকে ঝামেলা মনে করেন। তাই তাঁরা আইনজীবীদের মাধ্যমে সহায়তা নিয়ে জমা দিয়ে থাকেন। হুয়াওয়ের আরএফ ম্যানেজার আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকবার আইনজীবীদের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দিয়েছি, তাঁদের মাধ্যমে জমা দিলে তাঁরা নানা অজুহাত দেখিয়ে বেশি টাকা নেন। তাই আমি বলব, সবাই নিজে এসে রিটার্ন জমা দেন। কারণ রিটার্ন জমা দিতে কোনো রকম ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয় না।’

কর অঞ্চল-৪
কর অঞ্চল-৪-এ গিয়েও দেখা যায়, আয়কর জমা দিতে আসা মানুুষের ভিড়। তবে এ কর অঞ্চলে সরকারি চাকরিজীবীদের রিটার্ন জমা নেওয়া হচ্ছে। রিটার্ন জমা দিতে আসা কয়েকজন করদাতা জানান, মেলার চেয়ে কম সেবা দেওয়া হচ্ছে না। এ কর অঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও আন্তরিকতার সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমাসহ রাজস্বসংক্রান্ত অন্যান্য সেবা প্রদান করছেন। কর্মকর্তারাও বলছেন, দিন যত যাচ্ছে, করদাতাদের ভিড় বাড়ছে।

দুদকের সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান কর অঞ্চল-৪-এ রিটার্ন জমা দিয়ে বলেন, আয়কর মেলা হলে ভালো হতো। কারণ কর অঞ্চলেও ভিড়, মেলা হলেও ভিড় হতো। তবে অঞ্চল থেকে মেলায় বুথের সংখ্যা ও লোকজন বেশি থাকে। সমবায় অধিদপ্তরের উপজেলা সমবায় অফিসার মো. রাশেদ আলম বলেন, কর অঞ্চলে রিটার্ন জমা দিতে কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। মেলায় গিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া এবং কর অঞ্চলের মধ্যে রিটার্ন জমা দেওয়ার কোনো পার্থক্য দেখছি না।

বিভিন্ন কর অঞ্চলের কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেলার আদলে কর অঞ্চলগুলোতে করদাতাদের সব ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ রোধে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সেবা গ্রহণে করদাতাদের এবং সেবা প্রদানে কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তাঁরা বলেন, ‘সর্বোচ্চ করসেবা নিশ্চিত করতে আমরা চেষ্টা করছি। করদাতারা স্বাচ্ছন্দ্যে রিটার্ন দাখিল ও সেবা গ্রহণ করছেন।’ করদাতার সংখ্যা গতবারের চেয়ে বাড়ছে বলেও জানান তাঁরা।

করদাতাদের চাপ বাড়ছে
কর অঞ্চল-৪-এর কর কমিশনার আহম্মদ উল্লাহ উচ্চকণ্ঠ কে বলেন, ‘কর অঞ্চলগুলোতে রিটার্ন জমার বিষয়টি ভাগ করে দেওয়ায় আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়েছে। মেলা থেকে এখানে ব্যবস্থাপনায় অনেক সহজ হচ্ছে। তবে এভাবে আমাদের একটি সমস্যা হচ্ছে, সেটি হলো জায়গা সংকুলান। কারণ শেষ দিকে যেভাবে করদাতাদের চাপ বাড়ছে তাতে আমাদের কিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে হতে পারে। বিশেষ করে করোনা সংক্রমণের ভয়।’