গত ১ জুলাই থেকে দেশের কোন কোন ব্যবসায়ী কী পরিমাণ পেঁয়াজ, খেজুর, ভোজ্য তেল, ছোলা, চিনি ও ডাল কত দামে আমদানি করেছেন তার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। গত শনিবার থেকে শুরু করা এই তালিকা তৈরির কাজ আসন্ন ঈদ পর্যন্ত চলবে। রমজান সামনে রেখে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

কোনো আমদানিকারক অতিরিক্ত মুনাফা করতে এই ছয় খাদ্যপণ্য বেশি দামে বিক্রি করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করলে শুল্ক গোয়েন্দারা তাঁর আমদানি নিষিদ্ধ করার মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবে। জেল-জরিমানার মতো আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে আমদানিকারকের সব তথ্য স্বরাষ্ট্র, অর্থ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকারে পাঠানো হবে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। 

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আব্দুর রউফ কালের কণ্ঠকে বলেন, শবেবরাতের কয়েক দিন আগে থেকে রমজানের কেনাকাটা শুরু হয়। প্রতিবছরই এ সময়ে কিছু খাদ্যপণ্যের চাহিদা কয়েক গুণ বাড়ে। অতীতে দেখা গেছে, এই চাহিদা সামনে রেখে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনেছেন এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করেন। ব্যবসায়ীর কারসাজিতে বাধ্য হয়েই ভোক্তাকে এসব পণ্য কয়েক গুণ বেশি দামে কিনতে হয়। এবার রমজানে এসব কারসাজি রোধে আমদানিকারকদের আমদানির তথ্য শুল্ক গোয়েন্দারা অধিক গুরুত্ব দিয়ে সংগ্রহ করছে।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন লাভের জন্য। কিন্তু নিজের পকেট ভারী করতে মানুষকে কষ্ট দিয়ে জিম্মি করে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করা হলেই ধরা হবে। বাজারে কোনো পণ্য অতিরিক্ত বেশি দামে বিক্রি হলে খোঁজ নেওয়া হবে, তা কোন আমদানিকারক কী দামে কী পরিমাণে এনে কোন পাইকারি বিক্রেতার কাছে কত দামে বিক্রি করেছেন। যদি দেখা যায়, আমদানিকারক আমদানি করা দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করেছেন, তাহলে ওই আমদানিকারকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার মেট্রিক টন খেজুরের চাহিদা থাকলেও শুধু রমজানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন লাগে। রোজা ঘিরে আমদানিকারকরা এরই মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার টন খেজুর আমদানি করেছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা ২৪ লাখ টন। রমজানে চাহিদা থাকে আড়াই থেকে তিন লাখ টন। সারা বছর ১৮ লাখ টন চিনির চাহিদার তিন লাখ টনই লাগে রোজায়। সারা বছর পাঁচ লাখ টন মসুর ডালের মধ্যে শুধু রোজায় লাগে ৮০ হাজার টন। বছরে ৮০ হাজার টন ছোলার ৮০ শতাংশই রোজায় লাগে। বছরে ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের পাঁচ লাখ টনই দরকার হয় এ মাসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ডিসেম্বরে এক লাখ ৪৩ হাজার টন চিনি আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। জানুয়ারিতে তা বেড়ে দুই লাখ ৩৩ হাজার টন হয়েছে। ডিসেম্বরে ৫১ হাজার টন ছোলা, মসুর ও অন্যান্য ডাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়। জানুয়ারিতে তা বেড়ে হয়েছে ৯৫ হাজার টন। ডিসেম্বরে ১৪ হাজার টন খেজুরসহ অন্যান্য ফল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে। জানুয়ারিতে এ হিসাব বেড়ে হয়েছে ২৩ হাজার টন। তিন লাখ দুই হাজার টন ভোজ্য তেল আমদানির ক্রয়াদেশ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জানুয়ারিতে দেওয়া হয় দুই লাখ ৭১ হাজার টনের। ডিসেম্বরে প্রায় ১২৩ মিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের তেলবীজ আমদানি করা হয়েছে।

এবারের রোজায় দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে এরই মধ্যে এ ছয় পণ্যেও শুল্ককর কমানো বা মওকুফ করেছে এনবিআর। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এতে এ ছয় খাদ্যপণ্য এরই মধ্যে গত বছরের তুলনায় বেশি আমদানি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে পাম অয়েল আমদানি করা হয়েছে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার ২০৮ টন, গত পুরো অর্থবছর আমদানি করা হয়েছিল আট লাখ ৭৬ হাজার ৪৩৫ টন।

গত জুলাই-জানুয়ারিতে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করা হয়েছে তিন লাখ ৬৭ হাজার ৯৩৬ টন। আগের বছর একই সময়ে আমদানি করা হয়েছিল তিন লাখ ৪২ হাজার ৩৩৫ টন। গত অর্থবছরে কলাই ডাল আমদানি করা হয় এক লাখ ৭৯ হাজার ১১৪ টন। গত জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে দুই লাখ ৯০ হাজার ৩৮৪ টন। গত জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে ৬০ হাজার ৩৩১ টন চিনি আমদানি করা হয়েছে। গত বছর এই সময়ে আমদানি করা হয় ৫৭ হাজার ৬৯৫ টন।

দেশে ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বড় পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা বলেন, শবেবরাতের কয়েক দিন আগে থেকে খাদ্যপণ্য বিক্রি বাড়ে। ক্রেতার চাহিদা বিবেচনায় ব্যবসায়ীরাও প্রস্তুতি নিয়েছেন। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী এই চাহিদা সামনে রেখে কম দামে কিনে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করেন। কঠোরভাবে বাজার নজরদারি করা হলে এই কারসাজি রোধ করা সম্ভব।