সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢাকার রাস্তায় ধারণ করা একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন পুলিশ ও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে এক নারী ডাক্তারের উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা। ভিডিওকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে ডাক্তার ও পুলিশদের বাগযুদ্ধ, যুক্তি-পাল্টাযুক্তির খেলা চলছে। এই দুই পেশার বাইরের লোকেরাও থেমে নেই। কেউ এপক্ষে কেউ ওপক্ষে গিয়ে নানা মত-প্রতিমত তাদেরও। কিন্তু একজনও বলছেন না যে, দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সামনে এনে মানুষের বিপদের মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের, দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকারকারী দুটি পেশার লোকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়াটা ভীষণ অন্যায্য কাজ হচ্ছে।

জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ডাক্তার ও পুলিশের সমন্বয় ও পরিপূরক সহযোগিতা যখন সবচেয়ে বেশি দরকার, তখন এই পারস্পরিক ছিদ্রান্নেষণ, দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের খেলা বন্ধ করা, এই মুহূর্তে বন্ধ করা ভীষণ জরুরি।

ভাইরাল হওয়া ভিডিওটির শুরুতেই দেখা যায় ওই ডাক্তার কিছুটা ক্ষিপ্ত মেজাজেই পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেটকে বলছেন ‘আমি আইডি কার্ড নিয়ে আসি নাই’।

পুলিশ যখন জানতে চাইল ‘আপনার মুভমেন্ট পাস আছে?’

ওই ডাক্তার গাড়ির স্টিকার দেখিয়ে বললেন ‘এই যে মুভমেন্ট পাস’।

তখন সাদা শার্ট পরিহিত ব্যক্তি যিনি ম্যাজিস্ট্রেট বলে জানা গেছে তিনি বলেন, ‘আমিতো ওটা দেখতে চাচ্ছি না। আপনার মুভমেন্ট পাস আছে কি-না। আপনার আইডি কই?’

তখন ওই ডাক্তার জবাব দেন, ‘ডাক্তারের মুভমেন্ট পাস? কতজন ডাক্তারের প্রাণ গেছে করোনায়?’

একপর্যায়ে ওই ডাক্তার নিজের পরিচয় প্রকাশ করে বলেন, তিনি বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত এক মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে সাঈদা শওকত। উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের একপর্যায়ে তিনি পুলিশ এবং কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটক ‘তুই’ বলে সম্বোধন করলে তারাও ক্ষিপ্ত হন।

সাঈদা শওকত উত্তেজিতভাবে বলতে থাকেন ‘ডাক্তার হয়রানি বন্ধ করতে হবে’।

‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা বলে তুই আজ পুলিশ’ এমন মন্তব্য আসলে পুলিশের পক্ষ থেকেও একজন বলে ওঠেন তার বাবাও মুক্তিযোদ্ধা।

‘ডাক্তার বড় না পুলিশ বড়’- সেই প্রশ্ন তুলে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাঈদা শওকত জেনি।

ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওটি ধারণ করেছেন ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ। গণমাধ্যমকে ঘটনাটির বিস্তারিত জানিয়েছেন ওই ফটোসাংবাদিক।

কি ঘটেছিল তখন?
এলিফ্যান্ট রোড এলাকার ঘটনা এটি। জীবন আহমেদের গাড়িও রাস্তায় চেক করে পুলিশ। পুলিশের চেকিং শেষ হবার পর সেখানেই ছবি তুলছিলেন তিনি। ওই চেকপোস্টেই ডা. সাঈদা শওকতের প্রাইভেট কারটি আটকায় পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট, তার মুভমেন্ট পাস বা আইডি কার্ড দেখতে চান তারা। ‘তিনি ডাক্তার কি-না, তা জানতে আইডি কার্ড দেখতে চান তারা’।

এ সময় তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। পুলিশ বলছিল, আমিতো আইডি কার্ড দেখতে চাচ্ছি, আমিতো অপরাধ করছি না। আপনি খারাপ ব্যবহার করছেন কেন? এখানেতো অনেকেই অনেক পরিচয় দিয়ে বের হচ্ছে। এ জন্যেতো আপনি এ রকম ব্যবহার করতে পারেন না।

জীবন আহমেদের তথ্য অনুযায়ী সেখানে নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন। একপর্যায়ে ওই ডাক্তার একজন মন্ত্রীকেও কল করার চেষ্টা করেন।

জীবন আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই ডাক্তার যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনেকের ঘনিষ্ঠ সে রকম একটি ব্যাপার দেখানোর চেষ্টা ছিল এটি।

ডাক্তার আর পুলিশের এমন আচরণ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন উঠেছে। অনেকে দায়িত্বরত পুলিশের সঙ্গে ডাক্তারের এমন ব্যবহার করা কতটা সমীচীন সেই প্রশ্নও অনেকে তুলছেন। বিশেষ করে ডাক্তারের একটি মন্তব্য- ‘তুই মেডিক্যালে চান্স পাস নাই, তাই তুই পুলিশ। আমি চান্স পাইছি তাই আমি ডাক্তার’ এটি অনেকেই শেয়ার দিচ্ছেন।

তবে অনেকেই বলছেন- পুলিশের হয়রানি নিয়ে অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ থেকেই হয়তো এমন প্রতিক্রিয়া ডা. সাঈদার!

কেন এমন ঘটনা ঘটল?
নারীর পরনে অ্যাপ্রন, গাড়িতে ডাক্তারের স্টিকার লাগানো থাকা সত্ত্বেও পুলিশের পক্ষ থেকেই কেন বারবার আইডি কার্ড চাওয়া হচ্ছিল? কেনই বা ডা. সাঈদা এত ক্ষেপে গেলেন? সেই প্রশ্নের জবাব জানার চেষ্টা করা হয়েছে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা নিউ মার্কেট থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। পুলিশের মিডিয়া উইং থেকে এ বিষয়ে জানানো হবে বলে জানান তিনি।

এই ঘটনার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফতেখারুল ইসলাম বলছেন, ‘চলাচলে বিধি-নিষেধের এই সময়ে পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যানবাহন পরীক্ষা বা পরিচয়পত্র যাচাই করা, এটা কিন্তু তাদের নিয়মিত কাজের অংশ। চিকিৎসকসহ জরুরি সেবায় যারা নিয়োজিত, তাদের কিন্তু মুভমেন্ট পাসের কোনো দরকার নেই, তাদের আইডি কার্ডই যথেষ্ট’।

এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই কার্ড দেখতে চেয়েছিলেন, পুলিশ সহায়তা করছিল। এটা আমাদের নিয়মিত কাজেরই অংশ। তারপরে পুরো বিষয়টি তো আপনারা দেখতে পেয়েছেন’।

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় বিভিন্ন জরুরি সেবার নামে অপব্যবহারের ঘটনা ঘটতেও দেখা গেছে। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে রোগী নেই, কিছু নেই, মানুষ যাতায়াত করছে। এ রকমও দেখা গেছে’।

তিনি জানান, পরবর্তীতে তার চিকিৎসক পরিচয় নিশ্চিত হওয়ায় তাকে যেতে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ডা. সাঈদা শওকতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছেন। এ বিষয়ে পরে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

তবে ঘটনার পরপর ফেসবুকে ডাক্তারদের গ্রুপ ‘বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনে’ নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন ডা. সাঈদা। সেখানে তিনি লিখেছেন, তার গাড়িতে বিএসএমইউর পারমিশনের কাগজ, তার গায়ে প্রতিষ্ঠানের নামসহ অ্যাপ্রন থাকার পরও পুলিশ ঝামেলা করেছে। তিনি একে ‘ডাক্তার জাতি’কে অপমানের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি লিখেছেন, পুলিশ তাকে থানায় নেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দেয়। তিনিও তাই পুলিশকে কথা শোনাতে ছাড়েন নাই।

এই পোস্ট শেয়ার করে ডা. সাঈদাকে স্যালুট জানিয়ে তার পক্ষ নিয়েছেন অনেক ডাক্তার।

কেন ডাক্তারদের এমন প্রতিক্রিয়া?
লকডাউন শুরুর পর থেকে ফেসবুকে অনেক ডাক্তার অভিযোগ করে লিখছিলেন যে চেকপোস্টে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। এতে পুলিশের কর্মকাণ্ড সমালোচনার মধ্যে পড়লে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকেও একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয় যেখানে বলা হয় যে লকডাউনে যাতায়াতের সময় আইডি কার্ড দেখতে চাওয়াটা রুটিন ওয়ার্কের অংশ। এটা যাচাই করা পুলিশের দায়িত্ব আর চলমান বিধি-নিষিধের প্রেক্ষিতে পুলিশ এমনটা করছে।