টিকটক মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে ভারতে নারী পাচারকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত পাঁচ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব। তাদের মধ্যে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়া তিন নারী পাচারকারীকে পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাসের আদালত গতকাল বৃহস্পতিবার রিমান্ডের এই আদেশ দিয়েছেন। এর আগে আরো চারজনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, ভারতে পাচার হওয়ার ৭৭ দিন পর কৌশলে দেশে ফিরে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মামলা করে এক কিশোরী। মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি আইনে করা ওই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় মেহেদী হাসান, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের নামের তিনজনকে। গতকাল তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত প্রত্যেকের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশ জানায়, সম্প্রতি ভারতে গ্রেপ্তার মগবাজারের টিকটক হৃদয় বাবু এই নারী পাচারকারীচক্রের হোতা। এই চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রায় দেড় হাজার নারী পাচারের শিকার হয়েছে বলে তদন্তে জানা গেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাচারের শিকার এক কিশোরী দেশে ফেরার পর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে ১২ জনকে আসামি করে মামলা করে। এই আসামিদের মধ্যে পাঁচজন দেশে অবস্থান করছে বলে তথ্য ছিল পুলিশের কাছে। তাদের মধ্যে তিনজনকে মঙ্গলবার রাতে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে মেহেদী হাসান স্বীকার করেছে, ওই কিশোরীসহ দেড় হাজারের বেশি নারীকে তারা ভারতে পাচার করেছে। গ্রেপ্তার অন্য দুই আসামি মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের মামলার বাদী ভুক্তভোগীসহ পাঁচ শতাধিক নারীকে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়ে যেতে সহায়তার কথা স্বীকার করে। তারা ভুক্তভোগী নারীদের মোটরসাইকেলের মাধ্যমে সীমান্তে মানবপাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়।
সূত্র আরো জানায়, পাচারের শিকার নারীর সঙ্গে ২০১৯ সালে হাতিরঝিলে মধুবাগ ব্রিজে টিকটক হৃদয় বাবুর পরিচয় হয়। টিকটক স্টার বানানো বা ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দিয়ে ওই কিশোরীকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে বাবু। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট এবং ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করে বাবু। সর্বশেষ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে সহযোগীদের নিয়ে ওই কিশোরীকে ভারতে পাচার করে হৃদয় বাবু। পাচারকারীচক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা পর্যন্ত তার ওপর লোমহর্ষক নির্যাতন চালানো হয়।
তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ভুক্তভোগী নারীদের মোটরসাইকেলের মাধ্যমে সীমান্তে নিয়ে মানবপাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে মেহেদী হাসান। সে সাত-আট বছর ধরে নারী পাচারে জড়িত। মেহেদীর মোবাইল ফোন ও ডায়েরিতে টিকটক হৃদয়, সাগর, সবুজ, ডালিম ও রুবেলের ভারতীয় মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে।
ডিসি শহিদুল্লাহ আরো বলেন, ‘মেহেদীর ডায়েরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ভিকটিমের আধার কার্ড নম্বর ও ভারতে পাচারকৃত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভুক্তভোগীর নাম ও মানবপাচারে জড়িতদের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচারের কাজে ব্যবহারের জন্য নির্মিত কক্ষে ভুক্তভোগীর অবস্থানে সহায়তার পাশাপাশি তাদের মোটরসাইকেলযোগে সীমান্তের শেষ প্রান্তে ভারতীয় দালালের হাতে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে।
আরো যাদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে : সাতক্ষীরা থেকে মেহেদী, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদেরকে গ্রেপ্তার করার আগের দিন গত সোমবার নারী পাচারকারীচক্রের হোতা আশরাফুল মণ্ডল ওরফে বস রাফিসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়ে আরো তিনজন। অন্য একটি মামলায় তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
এ ছাড়া রাজশাহীতে টিকটিক ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছাড়ার প্রস্তুতির ঘটনায় তিন তরুণীসহ আরো ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা নগরীর পদ্মা গার্ডেন, ভদ্রা পার্ক, জিয়া পার্ক ও বিমান চত্বরে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেন।