করোনা মহামারির কারণে কলেজ বন্ধ। পড়াশোনা থমকে যাওয়ায় পিংকির (আসল নাম নয়) দমবন্ধ লাগে। অখণ্ড সময়ে স্মার্টফোনই হয়ে ওঠে বড় বন্ধু। পিংকি শুরু করে ফেসবুক ও মেসেঞ্জারের মতো অ্যাপস ব্যবহার। ফেসবুকের সুবাদে নিজ গ্রামের এক তরুণের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, ক্রমে যা গড়ায় প্রেমে। একদিন কৌশলে নিজেদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের চিত্র মোবাইল ফোনে ধারণ করে তরুণটি। সেই ফুটেজ ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তার পর থেকে চলতে থাকে অকথ্য নির্যাতন।
রাজশাহী শহরের একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির এই ছাত্রী সম্প্রতি যোগাযোগ করে। ভীত কণ্ঠে সে জানায়, আইনি সহায়তা চাওয়া দূরে থাক, এখন পর্যন্ত ভয়ে নিজের মা-বাবাকেও বিষয়টি জানায়নি। তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় ছেলেটির হুমকি, ‘কাউকে কিছু বলবি তো ভিডিওটি ভাইরাল করে দেব।’ সম্প্রতি পিংকির ভয় আরো বেড়েছে। কারণ কয়েক দিন ধরে তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সে যেন ওই ছেলের বন্ধুবান্ধবদেরও চাহিদা মেটায়। পিংকি বলে, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু আমি বাঁচতে চাই।’
এভাবেই ইন্টারনেট লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে অনেক পিংকির জীবন। অনলাইনে রঙিন স্বপ্ন দেখতে গিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে, জিম্মি হচ্ছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার গবেষণা বলছে, করোনাকালে মোবাইল ব্যবহার এবং ইন্টারনেট আসক্তি, দুই-ই বেড়েছে। এ কারণে বেড়েছে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, পারিবারিক অশান্তি, দাম্পত্য কলহ, এমনকি বিয়েবিচ্ছেদও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাকালে সাইবার অপরাধ বাড়ায় যারা এর শিকার হচ্ছে তাদের বড় অংশই নারী। সরল বিশ্বাসে ছেলেবন্ধুর সঙ্গে খোলামেলা ছবি বা ভিডিও আদান-প্রদান করছে তারা, কখনো তাদের অগোচরে ভিডিও করা হচ্ছে। এরপর গোপনে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে তারা, কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খুলছে না। সাইবার অপরাধ এবং নারী নির্যাতন বন্ধে আইন থাকলেও তা কাজে আসছে না।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, দেশে এসংক্রান্ত আইনের অভাব নেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে নারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠছে না। মেয়েরা সরল বিশ্বাসে একটি ছেলের কাছে সব কিছু নিংড়ে দিচ্ছে—এই অন্ধবিশ্বাস থেকে তাদের মুক্ত করার কাজটি শুধু আইন দিয়ে হবে না। এ জন্য দরকার সামাজিক গণসচেতনতাও। পাশাপাশি নারী ও শিশুবান্ধব দক্ষ পুলিশিং ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিচালক নিনা গোস্বামী বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে। তাদের তো এর ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা জানা নেই। বিশেষ করে ফেসবুক, টিকটক, লাইকিসহ ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রলুব্ধ করে নারীদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, অনলাইনে ফাঁদে ফেলে নির্যাতন প্রতিরোধে সাইবার পুলিশিংয়ে সক্ষমতা জোরদারের পাশাপাশি নজরদারিও জরুরি। বাংলাদেশ টেলিযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকেও (বিটিআরসি) আরো সক্রিয় হওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
তবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, ‘মানুষ নিজেরা যদি সচেতন না হয়, বিটিআরসির পক্ষে পাহারা বসিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ফেসবুক বা অন্য মাধ্যমে কে কার সঙ্গে চ্যাট করেন, কে কাকে হয়রানি করছেন, এসব তথ্য নজরদারিতে আনা সম্ভব নয়।’ তবে বিপদে পড়লে কেউ অভিযোগ নিয়ে গেলে তাঁরা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশে ধর্ষণের শিকার হয় এক হাজার ৪১৩ জন নারী। পরের বছর সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৬২৭ জনে। চলতি বছর প্রথম পাঁচ মাসে শিকার হয়েছে ৬০১ জন। স্বামীর হাতে খুন ও নির্যাতনের ঘটনায়ও ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। ২০১৯ সালে স্বামীর হাতে খুন হয়েছিল ৯৫ জন। পরের বছর সংখ্যাটি ছিল ২৪০। এ বছর পাঁচ মাসেই ২১৮ জন খুন হয়েছে। গৃহবিবাদের জেরে আত্মহত্যার হারও বাড়ছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে যথাক্রমে ৫৬ ও ৯০ জন এবং চলতি বছর পাঁচ মাসে ৬০ জন নারী আত্মহত্যার শিকার হয়। গত জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৫০২ জন নারী ধর্ষণ এবং ৯৯ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ২২ জন, আত্মহত্যা করেছে পাঁচজন।
আসকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দাম্পত্য কলহের জেরে হত্যা বা আত্মহত্যার শিকার যারা হয়েছে তাদের ৩৫ শতাংশই ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সী। ১৮ বছরের নিচে ১১ শতাংশ। ধর্ষণের শিকার ২৩ শতাংশই ১৩ থেকে ২৪ বছর বয়সী। ১২ বছরের নিচে ১৮ শতাংশ।
পারিবারিক কলহের মাত্রাও সীমাহীন বেড়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে গত বছর ১২ হাজার ৫১৩টি তালাকের আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সে হিসাবে মাসে গড়ে এক হাজার ৪২টির বেশি বা দিনে গড়ে ৩৫টি তালাকের আবেদন আসছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে এ সংখ্যা পাঁচ হাজার ৪৮৭।
বিয়েবিচ্ছেদের আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উভয় পক্ষের আবেদনেই কিছু অভিন্ন অভিযোগ আসছে। এর মধ্যে বেশি আসছে সন্দেহ, পরকীয়া এবং সংসারের প্রতি উদাসীনতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে পেছনে একটি কারণই বড় হয়ে ধরা দেবে—ডিজিটাল আসক্তি। ওখান থেকেই নানা ধরনের অশান্তির সূত্রপাত।
আসকের আরেকটি জরিপের তথ্যানুযায়ী, অনলাইনে ৩৬ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু বন্ধুদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ২৩ শতাংশ মেয়েশিশু যৌন কনটেন্টের মুখোমুখি হচ্ছে, ৪৬ শতাংশ অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব পেয়েছে। অন্যদিকে পুলিশের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অনলাইনে ভুক্তভোগীদের ৭০ শতাংশই নারী। তাদের মধ্যে ২৫ বছরের কম বয়সী নারী ৫৭ শতাংশ। নারীদের যারা সাইবার অপরাধের শিকার করছে তাদের ৫৮ শতাংশই ফেক আইডি বা হ্যাকড আইডি ব্যবহার করে নিজের পরিচয় লুকাচ্ছে। আক্রান্তদের বেশির ভাগের বয়সই ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন কালের কণ্ঠকে বলেন, বেশির ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা আইনের আওতায় আসে না। দু-একজন মাঝেমধ্যে সাহস করে বিচারপ্রত্যাশী হলেও মামলা ঝুলে থাকে। তিনি আরো বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন আর সামাজিক নেই। এটি যেন অসামাজিক কর্মকাণ্ডের ভাণ্ডার হয়ে উঠেছে। তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি উন্নয়নে পাঠ্যসূচিতে সচেতনতামূলক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকার, গণমাধ্যম, বেসরকারি সংস্থা এবং সাধারণ মানুষের সমন্বয়ে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। হাইকোর্টের এসংক্রান্ত নীতিমালাটিকেও অকার্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেটি কার্যকর হলেও কিছু মানুষ বিচারের আওতায় আসত।
রাজশাহীর ওই কলেজছাত্রী আরো জানিয়েছে, গোপনে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ দিয়ে তাকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও সে পরিত্রাণ পাচ্ছে না। এর মধ্যে তাকে আরো বেশ কয়েকবার শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেছে সায়মন। এমনকি কয়েক দফা টাকাও আদায় করেছে।