মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের মতো সশস্ত্র বাহিনীকেও যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। দেশের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়ে, অর্থাৎ দিনে বা রাতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যাবে। ছুটির দিনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায়ও কোনো বাধা থাকবে না। মোবাইল কোর্টসংক্রান্ত নির্দেশনায় শৃঙ্খলা বাহিনীসহ যেকোনো সরকারি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে। সহযোগিতা না করলে অপরাধ সংঘটন বা আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমন সব বিধান রেখে মোবাইল কোর্ট বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এক যুগ আগের মোবাইল কোর্ট আইনের অধীনে বিধিমালাটি প্রণীত হতে যাচ্ছে। বিধিমালার খসড়াটির ওপর মতামত দেওয়ার জন্য সম্প্রতি সব জেলার ডিসিদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে পরিচালিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় দুর্বলতা কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সম্প্রতি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে পরিচালিত মোবাইল কোর্টের শাস্তির বেশ কয়েকটি ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। মোবাইল কোর্ট নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের আগে থেকেই ‘মোবাইল কোর্ট বিধিমালা, ২০২১’-এর খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর অধীনে এসংক্রান্ত খসড়া তৈরি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উচ্চতর একাধিক পর্যায়ে অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের পর বিধিমালার খসড়াটি চূড়ান্ত করবে সরকার।
মোবাইল কোর্ট আইনের বৈধতা নিয়ে মামলা চলছে উচ্চ আদালতে। হাইকোর্ট বিভাগ আইনের কয়েকটি ধারা ও উপধারা অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। সরকারপক্ষ আপিলে গেলে আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন, যার শুনানি এখানো হয়নি। রায় স্থগিত থাকায় আইনের বিধিমালা প্রণয়নে বাধা নেই বলে মনে করেন রিট মামলার বাদী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান আজীম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিধিমালা করার চেয়ে সরকারের উচিত, মামলাটির শুনানির উদ্যোগ নেওয়া। তবে বিধিমালা প্রণয়নেও অনেক দেরি হচ্ছে, অনেক আগেই বিধিমালাটি করা উচিত ছিল।’
মোবাইল কোর্ট আইন প্রণয়নের পর থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় জনবল পেতে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেটদের। যদিও মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর ১২(১) ধারায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা প্রদানে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, কিন্তু এই সহায়তা না দিলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা আইনে নেই। খসড়া বিধিমালার বিধি ১৮(২) অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা বা আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। বিধি ১৮(৩) এই অসহযোগিতা প্রমাণিত হলে দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারার অপরাধ সংঘটনের দায়েও সরকারি ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী, কেউ সরকারি কাজের প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃতভাবে সহযোগিতা না করলে সংশ্লিষ্টদের জন্য ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
এদিকে মোবাইল কোর্ট আইনের ১২(১) ধারায় মোবাইল কোর্টকে সহযোগিতার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণ সময়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশ, র্যাবের সহযোগিতা নেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা, কিন্তু প্রস্তাবিত বিধিমালার বিধি ২-এ ‘শৃঙ্খলা বাহিনী’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘অর্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২-এর উপ-অনুচ্ছেদ (১)-এ বর্ণিত এবং অন্যান্য আইনে ঘোষিত শৃঙ্খলা বাহিনীকে বোঝাবে।’ এর মাধ্যমে নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীকেও বোঝানো হয়েছে। সংবিধানের ১৫২(১)-এ ‘শৃঙ্খলা বাহিনী’ বলতে ‘(ক) স্থল, নৌ বা বিমানবাহিনী; (খ) পুলিশ বাহিনী; (গ) আইনের দ্বারা এই সংজ্ঞার অর্থের অন্তর্গত বলিয়া ঘোষিত যেকোনো শৃঙ্খলা বাহিনী’কে বোঝানো হয়েছে।
মূল আইনে সশস্ত্র বাহিনীর কথা উল্লেখ না থাকায় বিধিমালায় তা অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আছে কি না, সে বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, বিধিমালা মূলত আইনের অধীন। তাই আইনে যা নেই বিধিমালায় এসংক্রান্ত মৌলিক কোনো বিষয় যুক্ত করার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনে সুনির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি। খসড়া বিধিমালার ৪(৪) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বা অপরাধ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সরকারি ছুটির দিনসহ দিনে অথবা রাতের যেকোনো সময়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যাইবে।’ অর্থাৎ বছরের ৩৬৫ দিনের রাত কিংবা দিনের যেকোনো সময়েই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যাবে।
বর্তমানে পরিচালিত মোবাইল কোর্টের বিচারকরা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারসংশ্লিষ্ট আদেশ বা কাগজপত্রের নকল দেওয়ার ক্ষেত্রে সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রস্তাবিত বিধিমালার ২০(৬) বিধিতে সেটা পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে দেওয়ার বাধ্যবাধ্যকতা রাখা হয়েছে। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তি তুলনামূলক দ্রুত মামলাসংশ্লিষ্ট কাগজ পেতে সুবিধা হবে। বিধি ২১-এ ডিজিটাল আলামতকে অপরাধের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করারও সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘মোবাইল কোর্ট ও আপিল আদালতের কার্যক্রমে প্রয়োজনবোধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর ও বায়োমেট্রিকস ব্যবহার করা যাইবে এবং অপরাধসংশ্লিষ্ট আলোকচিত্র, অডিও, ভিডিও বা উপযুক্ত অন্য কোনো উপায়ে গৃহীত তথ্য বা উপাত্তকে অপরাধের প্রমাণ বা আলামত হিসেবে ব্যবহার করা যাইবে।’
এদিকে বিশেষ প্রয়োজন ও পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্টকে সহযোগিতা করতে পারেন বা করে থাকেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন বা দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। তাঁরা ‘আইন-শৃঙ্খলা’ রক্ষা বাহিনীর সদস্য নন, তাঁদের পরিচয় ‘শৃঙ্খলা বাহিনীর’ সদস্য হিসেবে। যেমন—জাতীয় নির্বাচনের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত থাকেন। তখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে তাঁদের বিভিন্ন মোবাইল কোর্ট অভিযানে নেওয়া যায়। অন্যদিকে বর্তমানে করোনায় চলা বিশেষ সময়েও একাধিকবার ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করেছে সরকার।
মাঠ প্রশাসনের একাধিক ডিসি ও ইউএনওর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকালে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় যখন সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকে, সেই ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় তাদের সহযোগিতা নেওয়া যায়। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, বিশেষ পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনী যখন মাঠে থাকে তখন স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের কাজে লাগায়। কিন্তু আইনগত বা বিধির মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীকে মোবাইল কোর্টের সঙ্গে যুক্ত করার সুযোগ নেই। বিধিটি যেহেতু খসড়া পর্যায়ে, চূড়ান্ত পর্যায়ে এটি বাতিল করতে হবে বলেই মনে হয়।