মাদক গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়ে যারা চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের ৫৮ শতাংশই বন্ধুদের প্ররোচনায় মাদকে আসক্ত হয়েছে। নিজের কৌতূহল থেকে মাদকে আসক্ত হয়েছে ৪০ শতাংশ। মাদকাসক্ত রোগীর মধ্যে ২১ থেকে ২৫ বছরের তরুণদের সংখ্যাই বেশি, ২৫.৮৯ শতাংশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) অ্যানুয়াল ড্রাগ রিপোর্ট-২০২০ বা বার্ষিক মাদকবিষয়ক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে ইয়াবা ও হেরোইনে আসক্ত বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে। ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি আসক্ত হয় হেরোইনে, ৩৪.১ শতাংশ। মাদকাসক্তদের মধ্যে বেশির ভাগই বেকার, যাদের কোনো আয় নেই; এই হার ৫৭.৮৭ শতাংশ। বেশি ক্ষতিকর মাদকে আসক্ত হয়ে যারা রোগী হয়েছে তাদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত; এই হার ২৫.৩৮ শতাংশ।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ ডিএনসির চারটি সরকারি নিরাময়কেন্দ্র এবং ৩৭০টি বেসরকারি নিরাময়কেন্দ্রে ২০২০ সালে চিকিৎসা নেওয়া প্রায় ৩০ হাজার মাদকাসক্ত রোগীর ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রতিবছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে আগের বছরের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ বছর করোনার বিধি-নিষেধের কারণে সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সমীক্ষা প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে মাদক নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম গ্রহণ করছেন তাঁরা। সচেতনতা বাড়ানোর বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএনসির পরিচালক (নিরোধ শিক্ষা, গবেষণা ও প্রকাশনা) মুু নূরুজ্জামান শরীফ বলেন, ‘মাদকে আসক্ত রোগীর হার ও ধরন সমীক্ষা করে সে অনুযায়ী আমরা ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। সচেতনতার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চলছে।
পিআর গ্রুপ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বয়স ও পেশাকেন্দ্রিক সচেতনতার কাজ করছি। পাশাপাশি আভিযানিককাজও চলছে।’
ডিএনসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর কৌতূহল থেকে মাদকাসক্ত হয়েছে ৪০ শতাংশ রোগী। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৪৯.৪৯ শতাংশ; ২০১৮ সালে ১৭.১৩ শতাংশ; ২০১৭ সালে ২৪.১৫ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৩২.৮৪ শতাংশ ছিল। ২০২০ সালে বন্ধুর প্ররোচনায় মাদকাসক্ত হয় সবচেয়ে বেশি ৫৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে এভাবে আসক্ত হয় ৪৯.৮৩ শতাংশ; ২০১৮ সালে ৮১.২৭ শতাংশ (এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি); ২০১৭ সালে ৭৪.৯২ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে হয় ৬৪.৪৪ শতাংশ। ২০২০ সালে সহজে আনন্দ পাওয়ার আশায়, পরিবারের প্রতিকূল অবস্থার কারণে এবং মাদকদ্রব্যের সহজ প্রাপ্তির কারণে ০.৫০ শতাংশ হারে রোগী মাদকাসক্ত হয়। অন্য কোনো কারণে মাদকাসক্ত হওয়ার রোগী পায়নি ডিএনসি। তবে আগের চার বছর আরো পাঁচটি কারণে মাদকে আসক্ত হওয়ার প্রাথমিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সে হার ১ শতাংশেরও কম ছিল। কারণগুলো হলো মানসিক অসুস্থতা, বেকারত্ব, হতাশা, মাদকের ব্যাপারে সচেতনতার অভাব এবং চিকিৎসার ব্যাপারে জটিলতা।
জরিপে দেখা গেছে, গত বছরের মাদকাসক্ত রোগীদের মধ্যে ২১ থেকে ২৫ বছরের তরুণ ২৫.৮৯ শতাংশ। এর পরই ছিল ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সীরা এবং ২৬ থেকে ৩০ বছরের যুবকরা। বয়সের দুই ধাপেই হার ১৭.২৬ শতাংশ। আগেও এ বয়সেই আসক্তের হার বেশি দেখা গেছে। ২১ থেকে ২৫ বছরের আসক্ত রোগী ২০১৯ সালে ছিল ১৬.৭২ শতাংশ; ২০১৮ সালে ২০.৭২ শতাংশ; ২০১৭ সালে ১৯.২৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ১৮.৯৭ শতাংশ। গত বছর ৩১ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত আসক্ত রোগী ছিল ১৫.২৩ শতাংশ। গত বছর ১৫ বছরের নিচে শিশু ছিল ৪.৫৭ শতাংশ; ৩৬ থেকে ৪০ বছরের ৮.৬৩ শতাংশ; ৪১ থেকে ৪৫ বছরের ৩.৫ শতাংশ; ৪৬ থেকে ৫০ বছরের ৬.৯ শতাংশ এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব ছিল ২.৩ শতাংশ।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, হেরোইনে আসক্ত রোগীর সংখ্যা গত বছর বেশি ছিল, ৩৪.১ শতাংশ। এর পরই ইয়াবায় আসক্ত ২৭.৯২ শতাংশ। গত বছর বাড়লেও আগের দুই বছর হেরোইনের চেয়ে ইয়াবা এগিয়ে ছিল। এর আগের দুই বছর আবার হেরোইন আসক্ত ছিল বেশি। ২০১৯ সালে হেরোইনে আসক্ত রোগী ছিল ২৩.৭২ শতাংশ এবং ইয়াবায় ছিল ৩৯.৪২ শতাংশ; ২০১৮ সালে হেরোইনে ২৯.৮ শতাংশ এবং ইয়াবায় ৪২.৩ শতাংশ; ২০১৭ সালে হেরোইন ৩৩.৮৫ শতাংশ এবং ইয়াবায় ৩৫.৫৪ শতাংশ; ২০১৬ সালে হেরোইনে ৩৬.২৬ এবং ইয়াবায় আসক্ত ৩১.৬১ শতাংশ। গত বছরের জরিপে দেখা গেছে, ফেনসিডিলে আসক্ত ৩.৫ শতাংশ, গাঁজায় ১৯.২৯ শতাংশ, ইনজেকশনে নেওয়া মাদকে ৩.৫৬ শতাংশ, মদ্যপানে ১.২ শতাংশ, ঘুমের বড়ি সেবনে ১.২ শতাংশ, গুল সেবনে ০.৫২ শতাংশ এবং অন্যান্য মাদকে আসক্ত ৯.৬৪ শতাংশ রোগী।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছর মাদকাসক্তদের মধ্যে অশিক্ষিত ছিল ২৫.৩৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে অশিক্ষিত মাদকাসক্ত ছিল ৩৬.৩৫ শতাংশ; ২০১৮ সালে ৪৩.৪৬ শতাংশ; ২০১৭ সালে ২৩.৫৪ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ১৮.২৮ শতাংশ। গত বছর আসক্তদের মধ্যে ২০.৩০ শতাংশ ১০ বছরের শিক্ষাজীবন; ১৮.৭৮ শতাংশ পাঁচ বছরের শিক্ষা; ১৭.২৬ শতাংশ পেয়েছে ৯ বছরের শিক্ষা; ১০.৬৬ শতাংশ ১০-১২ বছরের; ৩.৫৫ শতাংশ ১৩-১৪ বছরের এবং ৪.৪ শতাংশ ১৫ বছরের শিক্ষাজীবন পার করেছে।
জরিপে দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের ২৬.৭৭ শতাংশেরই কোনো আয় নেই। পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা মাসে আয় করে ১৬.৬৭ শতাংশ। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয়ের ১৫.১৫ শতাংশ; ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় ১৩.৬৪ শতাংশের এবং ৩০ হাজার টাকার বেশি আয় ১০.১০ শতাংশের। আসক্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার ৫৭.৮৭ শতাংশ। গত বছর শিক্ষার্থী ছিল ১১.৬৮ শতাংশ; ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৭.১১ শতাংশ; সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী ৮.১২ শতাংশ; শ্রমিক ৫.৮ শতাংশ; গাড়িচালক ৫.৮ শতাংশ এবং অন্যান্য পেশার ৫.৮ শতাংশ ব্যক্তি।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস) কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। যেসব ক্ষেত্রে মাদকের ঝুঁকি আছে সেগুলো চিহ্নিত করে আমরা নজরদারি করছি।’
সূত্র জানায়, তেজগাঁওয়ে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ ডিএনসির চারটি সরকারি কেন্দ্রে ২০২০ সালে মোট ১৪ হাজার ৯৫২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে ৯ হাজার ১৭৯ জন নতুন রোগী। বাকি পাঁচ হাজার ৭৭৩ জন পুরনো রোগী। গত বছর দেশের ৩৭০ বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছে ১৫ হাজার ১৮১ জন। ২০১৯ সালে সরকারি কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছে ২৭ হাজার ৯৮৩ জন। ২০১৮ সালে চিকিৎসা দেওয়া হয় ২৫ হাজার ১৪৩ জনকে। ২০১৯ সালে বেসরকারি কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছে ১৩ হাজার ৮৫২ জন এবং ২০১৮ সালে ১২ হাজার ৮৯২ জন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার কারণে গত বছর সরকারি ও বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রে রোগীর সংখ্যা কম ছিল।