মুহাম্মদ রকিবুল হাসান, কুমিল্লা


অস্টিওপরোসিস হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ। অস্টিওপরোসিস রোগের প্রতিরোধ,  নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়তে প্রতি বছর এ দিনে  সারা বিশ্বব্যাপী বিশ্ব অস্টিওপোরোসিস দিবস পালন করা হয়। সর্বসাধারণকে হাড় ও পেশীর স্বাস্থ্য রক্ষায় আগাম ব্যবস্থা গ্রহণে এবং স্বাস্থ্য-কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদেরকে অন্যদের হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্বে উদ্বুদ্ধ করতে এই দিনটির উদযাপন।


আজ বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) দিবসটি উপলক্ষে সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. মাহাবুবুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বে কলেজ অডিটোরিয়ামে সকল মেডিকেল শিক্ষার্থী, ডাক্তার এবং কর্মচারীদের মিলিয়ে বিশাল এক সেমিনার আয়োজন করা হয় এবং আয়োজন শেষে একটি র‍্যালি বের করা হয় কলেজ প্রাঙ্গন থেকে। 


অনুষ্ঠান এবং র‍্যালিতে সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাহাবুবুল ইসলাম মজুমদার এবং তার নেতৃত্বে সহকারী অধ্যাপক  ডা. মোস্তাক আহমেদ, সহকারী অধ্যাপক ডা. নাজিমউদ্দীন, শিশু বিভাগের প্রধান ডা. জহিরুল আলম। 


উক্ত সেমিনারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলেন,বিশ্বে প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন করে আক্রান্ত হচ্ছেন এই হাড়ক্ষয় জনিত রোগে। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতিকারের চেয়ে এ রোগে প্রতিরোধই উত্তম।  অস্টিওপরোসিস বা হাড়ক্ষয় বলতে শরীরের হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়াকে বোঝায়।
উক্ত সেমিনারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ জানান, অস্টিওপোরোসিস হলো হাড় ছিদ্র রোগ। মানুষের ৪০ বছর বয়সের পর থেকেই হাড়ের ভেতরে খনিজ, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের পরিমাণ কমতে শুরু করে। এ কারণে হাড় ভঙ্গুর হয়ে যায়। এই হাড় ক্ষয় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না।


অস্টিওপরোসিসের অনেক কারণ আছে। প্রকৃতির নিয়মে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকে। এ জন্য ৫০ বা তার বেশি বয়সীরা এ রোগে আক্রান্ত হন। মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিক-পরবর্তী সময়ে হাড়ক্ষয়ের গতি খুব বেগবান হয়। এ ছাড়াও নানা কারণ বা ঝুঁকি হাড়ক্ষয়ের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। যাদের একবার হাড় ভাঙার ঘটনা ঘটে, তাদের পরবর্তী হাড় ভাঙার ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। একবার পাঁজরের হাড় ভাঙলে কোমরের হাড় ভাঙার আশঙ্কা ২-৩ গুণ বৃদ্ধি পায় এবং ঊরুর হাড় ভাঙার আশঙ্কা বাড়ে ১-৪ গুণ।
তাছাড়া ভিটামিন- ডি ও ক্যালসিয়াসের অভাব হলে এ রোগ দেখা দিতে পারে। আবার অল্প বয়সীদের কোনো কারণ ছাড়া অস্টিওপরোসিস হতে পারে। ধূমপান, মদপান এ রোগের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। 


রোগনির্ণয় 
এ রোগনির্ণয়ে বোন ডেনসিটি দেখে হাড়ে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ নির্ণয় করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বোঝা যায়। বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালে এ যন্ত্রের সাহায্যে অস্টিওপরোসিস নির্ণয় করার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া হাড়ের এক্স-রে করেও এ রোগ নির্ণয় করা যায়। রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা দেখতে হয়। রোগের কারণ নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে।
চিকিৎসা 


এ রোগ চিকিৎসা করানোর চেয়ে প্রতিরোধ করাই শ্রেয়। এ জন্য যাঁদের এ রোগের ঝুঁকি আছে, তাঁরা আগে থেকেই পরীক্ষা -নিরীক্ষা করে সচেতন হওয়া ভালো। তবে এ রোগ হয়ে গেলে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি ট্যাবলেট সেবন করতে হবে। এ ছাড়া হাড়ের ক্ষয় রোধ করে হাড় ঠিক রাখার জন্য বিসফসফোনেট জাতীয় ওষুধ সেবন করার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। 


তাছাড়া মেডিসিন বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. মাহাবুবুল ইসলাম মজুমদার জানান, বর্তমান বাজারে সবচেয়ে আধুনিক ” টেরিপ্যারাটাইড (Teriparatide) ব্র‍্যান্ড নাম Forteo নামের এক বিশেষ ওষুধ অস্টিওপরোসিস রোধ করে থাকে৷ এটি  মেনোপজাল মহিলাদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয় যাদের অস্টিওপোরোসিস আছে যাদের হাড় ভাঙ্গার (ফ্র্যাকচার) উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। এই ওষুধ অস্টিওপোরোসিস সহ মাসিক পরবর্তী বয়স্ক মহিলাদের মেরুদণ্ড এবং অন্যান্য হাড়ের ভাঙ্গা হাড় (ফ্র্যাকচার) হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে পারে।  তাছাড়া “টেরিপ্যারাটাইড” প্রাথমিক বা হাইপোগোনাডাল অস্টিওপরোসিসে আক্রান্ত পুরুষদের হাড়ের ভর বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয় যাদের হাড় ভাঙার (ফ্র্যাকচার) উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। যারা  কয়েক মাস ধরে প্রিডনিসোনের মতো গ্লুকোকোর্টিকয়েড ওষুধ ব্যবহারের কারণে অস্টিওপোরোসিসে আক্রান্ত পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই চিকিৎসার জন্য এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। 

প্রতিরোধ
অনুষ্ঠানে সকল চিকিৎসক জানায়, এ রোগ প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতনতার মাধ্যমে অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধ করার জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্কের প্রতিদিন ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম দরকার। কিন্তু মেনপোজের (মাসিক পরবর্তী সময়) হওয়া মহিলাদের অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি বেশি বলে তাদের প্রতিদিন ১৫০০ মিলিগ্রাম করে ক্যালসিয়াম খাওয়া দরকার। আর ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারের ভূমিকা অনেক বেশি। এ জন্য ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার। এ ছাড়া ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা যায়। ২০ মিনিট সূর্যের আলোতে থাকলে আমাদের প্রতিদিনের ভিটামিন ডি-র চাহিদা পূরণ হয়।  ভিটামিন ডি-এর চাহিদা পূরণে ডিম, কলিজা, ছোট মাছ ও শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে। অনেকে সামান্য অসুখেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করে থাকেন। এসব ওষুধ সেবনে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শমতো ব্যবহারে না করলে হাড়ক্ষয় হয়ে যেতে পারে। দেখা দিতে পারে অস্টিওপরোসিস। তাই এ ধরনের ওষুধ গ্রহণের সময় হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো চিকিৎসকের কাছ থেকে ভালো করে জেনে নেয়া প্রয়োজন। 


তাছাড়াও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেনপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, উপাধ্যক্ষ ডা. ফজলুল হক লিটন, হাসপাতালের পরিচালক লে. কর্ণেল. (অবঃ) ডা. মোঃ নুর নবী। উক্ত সেমিনার সার্বিক পরিচালনা করে মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. হোসাইন মোহাম্মদ সিহাব এবং সহোযোগিতায় উপস্থিত ছিলেন ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. মিনহাজুর রহমান।
সার্বিক পরিচালনায় দায়িত্বে ছিলো হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।