দেশের তরুণ প্রজন্ম (অধিকাংশ) নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছে স্মার্টফোনের মধ্যে। ওটাই যেন তাদের আরেক পৃথিবী। কিন্তু বাস্তবিক এ পৃথিবীতে কী ঘটে যাচ্ছে যেন তারা জানতেও চাইছে না।

২০২০ সালে বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী হবে ৬০ শতাংশ। এ সময়ে স্মার্টফোন ব্যবহার বৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ৭ নম্বরে উঠে আসবে বাংলাদেশ। বিশ্বের মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের (জিএসএম) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের শেষে দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫ কোটি ৭০ লাখে। ২০১৯ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে মোবাইল ফোনের গ্রাহক ছিল ১৪ কোটি ৫১ লাখ ১৪ হাজার।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় কোটি পাঁচ লাখ। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। এদের মধ্যে আট কোটি ৪৭ লাখ মোবাইল ফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী এবং বাকি ৮৩ হাজার ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। অর্থাৎ মোবাইল ফোনেই বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার হচ্ছে।

‘আমরা আগে অনেক কিছু ভাবতাম, স্বপ্ন দেখতাম, জীবন নিয়ে নানা প্ল্যান করতাম। কিন্তু এখনকার ছেলে-মেয়েদের কী যে হয়েছে! তারা মোবাইল থেকে বের হতে পারে না। একটা নতুন চিন্তা, নতুন প্ল্যান, অথবা জীবন সম্পর্কে কিছু ভাবতে শিখছে না। মোবাইল ফোনই তাদের এসব চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেট, চ্যাট বক্স, টিকটিক, ইনস্টাগ্রাম আর নানা ধরনের গেম নিয়ে ব্যস্ত তারা। এসবই তাদের মস্তিষ্কের মধ্যে বিস্তার লাভ করছে। আবেক, অনুভূতি, ফ্যামিলি বন্ডিং, আত্মীয়তা, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে তারা ক্রমান্বয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা নির্ভরতার প্রজন্মকে আর পাব না। তাদের কোয়ালিটি তৈরি হবে না, দিতে পারবে না নেতৃত্বও।’

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্মার্টফোনের প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখনকার কিশোররা বন্ধুর সান্নিধ্যে কম সময় কাটায়, তাদের মধ্যে ডেটিং কমছে, এমনকি পুরো প্রজন্মের ঘুম কম হচ্ছে। একাকিত্বের এ হার বাড়ায় সাইবার নিপীড়ন। হতাশা, উদ্বেগ ও আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। ‘হ্যাভ স্মার্টফোনস ডেস্ট্রয়েড আ জেনারেশন?’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে বর্তমান প্রজন্মের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার এক অধ্যাপক।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার রিকশাচালক আব্দুস সালাম। রাজধানীতে প্রায় ১২ বছর ধরে রিকশা চালান। মেরুল থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত যেতে যেতে আলাপ হয় এ রিকশাচালকের সঙ্গে। বলেন, তরুণ পোলাপানদের রাস্তায় মোবাইল টিপতে টিপতে যেতে দেখি, কানে হেডফোন। রিকশার বেল বাজালেও তারা শুনতে পায় না। ওরাই আবার মানুষের সঙ্গে ধাক্কা খায়, কারণ তাদের চোখ তো মোবাইলের দিকে। অনেক সময় রিকশায় দুজন একসঙ্গে ওঠে কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। নিজেদের মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত তারা। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আমরাই অনেক সময় বলি, ‘মামা চলে এসেছি, নামেন’।

কলম্বিয়ার ১৯ থেকে ২০ বছর বয়সী ৭০০ তরুণী এবং ৩৬০ কিশোর শিক্ষার্থীর ওপর এক গবেষণা চালান সিমন বলিভার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, দিনে পাঁচ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে যেসব শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন, তাদের স্থূলতার ঝুঁকি বাড়তে পারে। তারা সতর্ক করেছেন, অতিরিক্ত সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারে অন্যান্য বাজে অভ্যাস তৈরি হয়, যাতে হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, দিনে পাঁচ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে স্থূলতার ঝুঁকি ৪৩ শতাংশ বাড়ে। তাদের শারীরিক সক্রিয়তা কমে, এতে অকালমৃত্যু, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও নানা ধরনের ক্যান্সার হতে পারে।

মোবাইল ফোনের প্রতি অত্যাধিক আসক্তির বিষয়ে কথা হয় রাজধানীর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার তুরণ জুবায়ের আল হাসানের সঙ্গে। বলেন, ‘বন্ধুদের সবার হাতে লেটেস্ট ফোন, আমারটা একটু পুরাতন ছিল। বন্ধুরা মিলে অনলাইনে একসঙ্গে একটি জনপ্রিয় অ্যাকশন গেম খেলি, সে কারণে ভালো রেজুলেশন, গ্রাফিক্স, রোম, র্যাম ভালো দরকার হয়। তাই বাসায় জেদ করে এই লেটেস্ট ফোন কিনেছি।’

মোবাইলের প্রতি এত আসক্তি কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বললেন, ‘মাঠে ক্রিকেট-ফুটবল খেলতে ভালো লাগে না, তাই মোবাইলেই গেম খেলি। সবাই একসঙ্গে অনলাইনে খেলতে লাগলে কোন সময় ঘণ্টা পার হয়ে যায় তা বুঝতে পারি না। ফেসবুক, ইউটিউব তো আছেই। সামাজিক যোগাযোগটা ফেসবুকের মাধ্যমেই হয়ে যায়। মোবাইল আর খাবার দিলে দিনের পর দিন নিজ ঘরে বসেই সময় কাটিয়ে দিতে পারব।’

‘মোবাইল আর ইন্টারনেট- আমাদের জীবনেরই অংশ’- এসব ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কীভাবে চলি বলেন-পাল্টা প্রশ্ন তার!

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, আমাদের বাচ্চারা বর্তমানে ক্রিয়েটিভ কোনো চিন্তা করে না। নতুন প্রজন্ম সারাক্ষণ স্মার্টফোনে ডুবে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তির ফলে আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোও কমে যাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন অনেক সরু হচ্ছে। আগে বাচ্চারা প্রচুর ছোটাছুটি ও খেলাধুলা করত। কিন্তু এখন স্মার্টফোন অ্যাডিকশনের কারণে শারীরিক, মানসিক ক্ষেত্রে চাপ পড়ছে। তাই বাচ্চাদের জন্য বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।

অধ্যাপক সালমা মনে করেন, বাবা-মা ব্যস্ত থাকলে বাচ্চারা তাদের সঙ্গে মিশতে পারে না। তখনই তারা বিভিন্ন বিষয়ে আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই বাবা-মায়ের উচিত বাচ্চাদের মোটিভেট (প্রেরণা জোগানো) করা, একটু হলেও সময় দেয়া। তারা কোন বিষয়ে আগ্রহী, সেটা খুঁজে বের করা।

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদের এ বিষয়ে বলেন, মোবাইলে-ইন্টারনেটে তরুণ প্রজন্মের এমন আসক্তি উপলব্ধি করে আমরা ‘মুঠোফোন ও ইন্টারনেটের অপব্যবহারে আজ তরুণ প্রজন্ম ও সমাজ ব্যবস্থা ধ্বংসের সম্মুখীন’ শীর্ষক এক সেমিনার করেছি। এ বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে বেশকিছু সুপারিশ আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- মুঠোফোন, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বিধি ও নীতিমালা তৈরি। এটি এখন সময়ের দাবি। তথ্যপ্রযুক্তি আইন সম্পর্কে স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা, হাট-বাজার সব জায়গায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো। ইন্টারনেটের ভালো দিকগুলো সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো যাতে এ খাত ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্ম ঘরে বসেই অর্থ আয় করতে পারে। এসব বিষয়ে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করে এর অপব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান এ খাত নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে তাদের অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে।