১০ বছর আগে ফরিদপুরের হাটে ভালো মানের এক মণ পাটের দাম ছিল ১৮শ টাকা। আর শ্রমিকের মজুরি ছিল সর্বোচ্চ তিনশত টাকা। বর্তমানে এই মজুরি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪শ টাকায়। সেই সঙ্গে বেড়েছে জমির বর্গা মূল্য, সার, বীজসহ আনুষঙ্গিক জিনিষপত্রের দাম। তবে সেই অনুপাতে বাড়েনি পাটের দাম।

বর্তমানে ফরিদপুরের বাজারে সোনালী আঁশ পাটের মণ প্রতি গড় মূল্য ১৪শ টাকার মতো। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ভালো মানের সদৃশ পাট বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৮শ টাকা দরে। আর মিলসাট বা নিম্নমানের পাট হলে এক হাজার টাকা মন দরেও দাম পাওয়া যাচ্ছে না। গত বুধবার ৪ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের মধুখালী ,কামারখালী , কানাইপুর, সাতৈর, পুখুরিয়াসহ প্রসিদ্ধ হাটে পাটের বাজারমূল্য ছিল এমনই।সংশ্লিষ্ট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, পাটের রাজধানীখ্যাত ফরিদপুরে এ বছর সরকারি হিসেব অনুযায়ী পাটের আবাদ হয়েছে ৮২ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে। বিপরীতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮১ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন। আর গত বছর জেলায় ৮৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে পাট আবাদ হয়েছিলো ৮৫ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে। এক মৌসুমের মধ্যেই ফরিদপুরে পাট চাষের পরিমাণ কমার নেপথ্যে পাটের মূল্য না বাড়ার কারণকেই দায়ী করছেন কৃষকেরা।

ফরিদপুরের চরভদ্রাসন, সদরপুর ও আলফাডাঙ্গা বাদে জেলা সদরসহ বোয়ালমারী, মধুখালী, ভাঙ্গা, নগরকান্দা ও সালথা উপজেলার ব্যাপক জমিতে পাটের আবাদ হয়ে থাকে। এরমধ্যে তোষা জাতের পাটই ৯০ শতাংশ জমিতে আবাদ করা হয়।
সরেজমিনে ফরিদপুরের বিভিন্ন হাট ঘুরে দেখা যায়, এসব হাটে বড় বড় মহাজনী-পাইকার ব্যবসায়ীদের লোকেরা কৃষকদের নিকট থেকে পাট কিনছেন। সরাসরি মিল গেটে কৃষকের পাট বিক্রির কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে কৃষকের পাটের মুনাফার একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল-ফড়িয়াদের দখলে। গত ১০ বছরেও পাটের দাম না বাড়ায় এসব পাটচাষিরা হতাশ। পাট বিক্রির মৌসুমে তাদের অনেকেই পাট বিক্রি করে হাসি মুখের পরিবর্তে মলিন মুখে বাড়ি ফিরছেন। দীর্ঘদিন যাবত তারা পাটের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসলেও তাদের এ দাবি পূরণ হয়নি।

ফরিদপুরের কানাইপুর ইউনিয়নের মৃগী গ্রামের পাটচাষি মো. শাজাহান মোল্যা বলেন, ৫২ শতাংশের এক বিঘা জমিতে পাট উৎপাদন করতে তার প্রায় ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সবমিলিয়ে পাওয়া গেছে ১০ মনের কিছু বেশি পাট। এই পাট বিক্রি করে তেমন লাভের মুখ দেখা যাবে না বলে আক্ষেপ করেন তিনি। কারণ, বাজারে এখন পাটের দাম পড়তি। মৌসুমের শুরুতে ২২শ টাকা দরে এক মন পাট বিক্রি হলেও এখন তা কমে সর্বনিম্ন ৯শ টাকা দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ভালো মানের এক মন পাট এখন ১৮শ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

আব্দুল হালিম শেখ নামে ভাঙ্গা উপজেলার এক কৃষক জানান, গত এক দশকের মধ্যে পাটের সর্বোচ্চ দাম পাওয়া গিয়েছিল ২০১০ সালে। সেবার ভাল মাণের এক মন পাট ২৬শ টাকা দরেও বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে দাম ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। গত বছরও পাটের দাম কিছুটা বেড়ে এক মন পাট ২২শ থেকে ২৩শ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু এ বছর আবারও কমে গেছে।

মধুখালীর খোদাবাসপুর গ্রামের পাট চাষি মো. বিল্লাল শেখ আক্ষেপের সাথে বলেন ৬৩ শতাংশ জমিতে পাট চাষ করে মাত্র ১৫ মণ পাট উৎপাদন হয়েছে যা বর্তমান বাজার মূল্যে বিক্রি করতে গেলে ১২ হাজার টাকার অধিক লস হবে।

লাভ না হলে কেন তারা পাটচাষ করছেন এ প্রশ্নের জবাবে বোয়ালমারীর হাটখোলারচর গ্রামের মো. ইউনূচ শেখ বলেন, এসব কৃষকেরা পাটচাষে অভ্যস্ত। তাই এক ধরনের মোহে পড়েই পাটচাষে মনোনিবেশ করে কৃষকেরা। যারা নিজস্ব জমিতে পাটের আবাদ করে তারা কিছুটা সুবিধা পেলেও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে পাটচাষ করে গরিব চাষিরা লাভের মুখ দেখতে পায় না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বোয়ালমারী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ রাসেল রেজা জানান, কৃষকের ক্ষতি পূরণের স্বার্থে আমরা পাটের দাম তিন হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছি। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রোধে প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারি পাট ক্রয়কেন্দ্র চালুরও দাবি জানিয়েছি। কিন্তু আমাদের এসব দাবির প্রতি কর্ণপাত না করায় কৃষকেরা ক্ষতির সম্মুখীন বলেও তিনি জানান। দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল পাটের সঙ্গে জড়িত কৃষকদের স্বার্থের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে  বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

এ ব্যাপারে ফরিদপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, এ বছর পাটের আবাদ সন্তোষজনক। তবে বৃষ্টির অভাবে খাল-বিলে পানি জমেনি। ফলে পাট জাগ দিতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে কৃষকদের। ভালোভাবে জাগ দিতে না পারায় পাটের রং আসেনি। এজন্য সাধারণ কৃষকদের মধ্যে পাটের দাম নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে।