দুর্নীতি, অনিয়ম, সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অমান্যকারী, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত, সংগঠনে গ্রম্নপিং-কোন্দল সৃষ্টিকারী ও ক্যাডার পলিটিক্সে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলে, সরকারে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এ নীতি অবলম্বন করে তিনি সামনের দিনগুলোতে পথ চলতে চান। জানা গেছে, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদেরও আর ছাড় না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও প্রশাসন পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হয়নি, তবে ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখাও’ প্রবাদটি মাথায় রেখে তিনি ঘর থেকেই দুর্নীতিবিরোধী কর্মকান্ড শুরু করেছেন। গত শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় শেখ হাসিনা আবারও দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
এরই অংশ হিসেবে দুর্নীতি, অনিয়ম, চাঁদাবাজি ও নেতাদের অবমূল্যায়নের অভিযোগ আমলে নিয়ে গত শনিবার ছাত্রলীগের কমিটি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ পদের দুইজন নেতাকে একসঙ্গে সরিয়ে দেয়ার ঘটনা এই প্রথম। এর আগে গত সোমবার ও বুধবার (৯ ও ১১ সেপ্টেম্বর) তৃণমূলের বিভিন্ন ইউনিটের পদদধারী ১৭৭ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। তারা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে দলমনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। জানা গেছে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত মদদদাতাদেরও কারণ দর্শনোর নোটিশ পাঠানো হবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য ও দলীয় সংসদ সদস্যদের ওপরও তীক্ষ্ন নজরদারি রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। দল, অঙ্গ ও সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব সম্পর্কেও নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন তিনি। দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা সাংগঠনিক কাঠামোকে অবমূল্যায়ন করে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানান এই নীতিনির্ধারকগণ।
দল, সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারের দুইজন মন্ত্রী, তিনজন প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের দুইজন হুইপ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিভাগীয় পদে থাকা সাতজন নেতা, বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত ডজনখানেক সংসদ সদস্য, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দুইজন শীর্ষ নেতা, সাবেক দুই নেতা, যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় তিনজন নেতা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের দুইজন নেতা, যুব মহিলা লীগের দুইজনসহ বেশ কিছু নেতা নজরদারিতে রয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেতা, স্থানীয় নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অভিযোগ রয়েছে। এসব নেতা সম্পর্কে সংবাদপত্রে ও মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য, বিভিন্ন সংস্থার গোপন জরিপ ও সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের পাঠানো তথ্যসমূহ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এমনকি ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে কী করছেন তার তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতি ও অনিয়মে সম্পৃক্তরাও ছাড় পাবেন না এবার। যাদের বিরুদ্ধে কমবেশি দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার একাধিক ব্যক্তি এসব কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। জানা গেছে, সচিবালয়সহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের ওপর নিবিড় নজরদারি রাখছে একাধিক বিধিবদ্ধ ব্যক্তি। বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গত শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ, অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যারা চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত, যারা মানুষকে হয়রানি ও মাস্তানি করে তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। এ সময় তার আসন্ন জন্মদিন উপলক্ষে যুবলীগের মাসব্যাপী দোয়া মাহফিলের বিষয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, চাঁদাবাজির টাকা হালাল করতে যারা এসব করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন দোয়ার প্রয়োজন নেই বলেও জানান তিনি। জানা গেছে, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ, দলে গ্রম্নপিং-কোন্দল সৃষ্টিকারী, দলকে ব্যবহার করে নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারীদের আর ছাড় দেয়া হবে না। এদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের দলীয় পদ হারাতে হবে এবং আগামীতে কোনো পদ পাবেন না।
এদিকে দল ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে যারা নানা অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত বা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা এখন নানা ধরনের আতঙ্কে রয়েছেন। অনেক নেতাকর্মীই ভিড় করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসভবনে। আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির কার্যালয় ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এখন এ নিয়ে নানা গবেষণা ও পর্যালোচনা চলছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যারা শেখ হাসিনার কাছে গ্রহণযোগ্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতার বাসায় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার দেখা মিলছে। অনেক নেতাকর্মী আবার নিজ নিজ এলাকার নেতা বা এমপিকে নিয়ে ফোড়ন কাটছেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার যে অব্যাহত লড়াই তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল ছাত্রলীগের দুই নেতার বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে। তিনি বলেন, দুর্নীতি আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দুর্নীতি আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ একসঙ্গে চলতে পারে না। সেজন্য ছাত্রলীগ বা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীই শুধু নয়, আমলা, প্রশাসনিক ব্যক্তি, শিক্ষকসহ সমাজের সর্বস্তরে থাকা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি সংগঠনের দুইজন শীর্ষ নেতাকে দুর্নীতির দায়ে বিদায় নিতে হলো। এই সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার প্রতি জনগণের আস্থা আরও বাড়াবে। তার মতে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা গড়তে শেখ হাসিনা ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা মূল নিয়ামক।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, দুর্নীতি, অনিয়ম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দল বা সরকারে যারা এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের কাউকে আর ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে দলপ্রধান একাধিকবার সাংগঠনিক ফোরামে বা ব্যক্তিগতভাবে অনেককে সতর্ক করেছেন। যারা সে সতর্কবার্তা মানবেন না তাদের জন্য করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে।
তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম যায়যায়দিনকে বলেন, ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থা প্রমাণ করে তারা কত বড় অপরাধী ছিল। এই পদক্ষেপের জন্য শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানানোর কিছু নেই উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ নেতাদের এ ধরনের অপরাধের পাশাপাশি বালিশ কেলেঙ্কারি, পর্দা কেলেঙ্কারি প্রমাণ করে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে পচন ধরেছে। তিনি দাবি করেন, লুটপাটের বাজার অর্থনীতির চলমান ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েমের মধ্য দিয়েই কেবল দুর্নীতি ও অনিয়মমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব।
প্রধান তথ্য কমিশনার মরতুজা আহমদ যায়যায়দিনকে বলেন, তথ্য অধিকার আইনের মূল কথা হলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে দুর্নীতি দূর করা। সুশাসন নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করে যেভাবে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সমাজচিন্তক সৈয়দ আবুল মকসুদ যায়যায়দিনকে বলেন, ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতাকে সরিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দেয়া শূন্য সহিষ্ণুতার ঘোষণা বাস্তবে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়টি শেখ হাসিনার পর্যায়ে যেতে হবে কেন বা সব কিছুর দায়িত্ব তাকেই কেন নিতে হবে? আরও নিচের দিক থেকে এর ফয়সালা হতে পারত। তিনি দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই দুই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের দাবি জানান।