পরিবহন নেতাদের চাপে গেজেট পাসের পরও সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করা যায়নি। আইনের কিছু জামিন-অযোগ্য ধারা এখন সংশোধন করে জামিনযোগ্য করা হচ্ছে। যুক্ত করা হচ্ছে নতুন বিধানও। বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনায় কারও জীবনের ‘ক্ষতি’ হলেও জামিনের সুযোগ রাখা হচ্ছে। অথচ আইনটি প্রণীত সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী জামিন-অযোগ্য।
গত বছরের ৮ অক্টোবর আইনটির গেজেট প্রকাশের পর থেকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বিআরটিএ বলছে আইনটির বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। বাস্তবায়নের আগে আইন সংশোধনের উদ্যোগের খবর অস্বীকার করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, আইন সংশোধন হচ্ছে না। এটি শুধুই ‘গুঞ্জন’ বলে মন্ত্রী মন্তব্য করেন। তিনি এ-ও বলেছেন, সুপারিশ এলেই তা মানতে হবে এমন নয়। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র আইনটির সংশোধনের উদ্যোগের ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর প্রায়োগিক দিক নিয়ে গঠিত মতামত সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেখানে সরকারের তিনজন মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা কাজ করেন। তাদের কোনো মতামত এলে তখন বলা যাবে। শুধু এটুকু বলতে চাই, আইনের এমন কোনো দিক পরিবর্তন হবে না, যা ‘মানুষের’ স্বার্থবিরোধী।
এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান আমাদের সময়কে জানান, বর্তমানে বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। শিগগির তা মন্ত্রণালয়ে জমা হবে।
জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে সড়ক

পরিবহন আইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। নানা বাধা-নাটকীয়তা শেষে সংসদ এবং মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত রূপ পায়। এর পর তা গেজেট আকারে প্রকাশের পর আসে সেই পুরনো ‘দাবি’ সংশোধনের চাপ। অনেকটা তা-ই মাথা পেতে নিতে হচ্ছে।
গেজেট পাস হওয়া সড়ক আইনে বলা হয়, এ আইনের ধারা ৮৪, ৯৮ ও ১০৫-এর অধীনে সংঘটিত অপরাধ জামিনযোগ্য নয়। এখানে সংশোধনী এনে ধারা ১০৫ ছাড়া অন্য সব অপরাধ জামিনযোগ্য করা হচ্ছে।
দেখা গেছে, ধারা ৯৮-এ বলা আছেÑ অতিরিক্ত গতিতে, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালনা, ওভারলোডিং করলে কারও জীবন বা সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে চালক, কন্ডাক্টর বা সহায়তাকারী অনধিক ৩ বছর কারাদ-, অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দ-ে দ-িত হতে পারেন। এ অপরাধে অর্থদ-ের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন আদালত। এ ধারা পাস হওয়া আইন অনুযায়ী জামিন-অযোগ্য। এখন তা জামিনযোগ্য করা হচ্ছে। কেবল ধারা ১০৫-এর অধীনে সংঘটিত অপরাধকে জামিন-অযোগ্য হিসেবে রাখা হয়েছে। ধারা ১০৫-এ বলা আছে, দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি আহত হলে বা প্রাণহানি ঘটলে ৫ বছরের কারাদ- বা অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দ-ে দ-িত হতে পারে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, ধারা ১০৫ জামিন-অযোগ্য হলেও ধারা ৯৮-এর সুযোগ নিয়ে দুর্ঘটনায় দায়ী চালক বা সহযোগীরা জামিন পেতে পারেন। কারণ ধারা ৯৮-এ মোটরযান দ্রুত চালনা বা বেপরোয়া বা ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিংয়ের ফলে দুর্ঘটনায় আহত, জীবন ও সম্পত্তির ‘ক্ষতি’ সাধনের কথা উল্লেখ আছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না বলেন, আইনের ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ১০৫-এর পরিবর্তে ৯৮ দেখানো হতে পারে। জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি হলেও যদি জামিনের সুযোগ থাকে তা হলে আইনের মারপ্যাঁচে সেই সুযোগ মিলতেই পারে।
এদিকে সড়ক আইনের ধারা ৮৪-তে বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৪০-এর বিধান লঙ্ঘন করেন তা হলে অনধিক ৩ বছরের কারাদ-, অন্যূন ১ বছর বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দ-ে দ-িত হবেন। ধারা ৪০-এ রেজিস্ট্রেশনকৃত গাড়ির কারিগরি দিক পরিবর্তন, গাড়ির রঙ এবং গাড়িতে থাকা বিভিন্ন বাধ্যবাধকতার বিষয় উল্লেখ আছে। যেমন- আসনবিন্যাস, স্পিড গভর্নর, ব্রেক ও স্টিয়ারিং গিয়ার, হর্ন, সেফটি গ্লাসসহ বিভিন্ন উপকরণের বিবরণ রয়েছে।
পরিবহন নেতাদের পরামর্শে সংশোধন হচ্ছে কন্ডাক্টরের সংজ্ঞা। ধারা ২ (৯)-এ কন্ডাক্টরকে সুপারভাইজার হিসেবেও চিহ্নিত করা হচ্ছে। এটি অবশ্য ভালো দিক। কারণ অনেক গাড়িতে প্রচলিত কন্ডাক্টরকে সুপারভাইজার হিসেবে ডাকা হয়। তা ছাড়া চালক নিয়োগের শর্তসংক্রান্ত ধারা ১৩-এ কিছু নতুন শর্ত যোগ করা হচ্ছে। এই ধারায় চালক নিয়োগের জন্য লাইসেন্স, লিখিত নিয়োগপত্র থাকার কথা বলা আছে। কিন্তু এসব বিধান লঙ্ঘন করলে কোনো দ- আরোপের ধারা নেই। তাই সেখানে ১০ হাজার টাকা অর্থদ-ে দ-িত করার ধারা সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ আইনের ১৪ ধারায় কন্ডাক্টরের লাইসেন্সের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। থাকতে হবে নিয়োগপত্র। কন্ডাক্টরকে যেমন সুপারভাইজার বলা যাবে, তেমনি হেলপার কাম ক্লিনার শব্দটিও যুক্ত হচ্ছে সংশোধনীতে।
চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, আইনটির প্রায়োগিক দিক নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর সমন্বয়ে কমিটি হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলে জমা দেওয়ার কথা। এ কমিটিরই ৪র্থ বৈঠকশেষে গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী কিছু সংশোধনীর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা আইনটি যখন তৈরি করেছি, তখন তাদের (পরিবহন মালিক-শ্রমিক) কিছু দাবি-দাওয়া ছিল। সেই দাবি-দাওয়াগুলো সম্পূর্ণভাবে আইনে আসেনি, এটি তাদের ডিমান্ড ছিল। সে জন্য পাস হওয়া আইন প্রয়োগের কোথায় সমস্যা হচ্ছে, কেন হচ্ছে সেটা দেখার জন্য বসেছি।
আইনটি আবার সংশোধন হতে পারে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, এটা হতে পারে। যদি জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল মনে করে আইনটি সংশোধন দরকার তা হলে তারা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংসদে নিয়ে যাবে। কিন্তু এর পর ২৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তা অস্বীকার করে বলেছিলেন, আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদিও সংশ্লিষ্টরা ওই আইন সংশোধনের পথেই হাঁটা নিশ্চিত করেছে।