রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর রোডের মাথায় ফজর আলী মাতবরের বস্তির পাশে প্রায় দিনই বেলুন বিক্রি করতে আসতেন বেলুনওয়ালা আবু সাঈদ। অন্যান্য দিনের মতো গতকাল বুধবার বিকেল ৩টার দিকে বেলুন বিক্রি করতে এসেছিলেন তিনি। বেলুন ফোলানোর জন্য সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন একটি গ্যাস সিলিন্ডার। তাঁকে ঘিরে ছিল ২০-২৫ জন শিশু। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণে ফেটে যায় গ্যাস সিলিন্ডারটি। আকাশের দিকে উঠে যায় ধোঁয়া আর নিচে শিশুদের রক্তে ভেসে যায় রাস্তা।
বিস্ফোরণে ছয় শিশু নিহত হয়েছে। নিহত শিশুরা হলো শাহীন (৯), নূপুর (৯), ফারজানা (৫) রমজান (৮), রিয়া মনি (৭) ও রুবেল (১১)। আহত হয়েছে আরো অন্তত ২০ শিশু ও এক নারী। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে এলাকাবাসী জানায়।
গতকাল সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বিস্ফোরণস্থলের রাস্তায় শিশুদের রক্ত। রক্তের পাশে পড়ে আছে স্যান্ডেল, হাতের চুড়ি, সিলিন্ডারের ভাঙা অংশ। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ঘটনাস্থলে এসে ভিড় করে। সবাই হাহাকার করছে। যে শিশুরা মারা গেছে তাদের পরিবারে মাতম চলছে। এ ঘটনায় পুরো বস্তিবাসী শোকস্তব্ধ। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে আতঙ্কে অসুস্থ অবস্থায় রয়েছে।
বস্তির বাসিন্দা আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এইডা কী দেখলাম। শিশুগোলা বেলুনওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়াইছিল। এর মধ্যেই বিকট শব্দ হইল। আর দেখতে পাইলাম ওপরের দিকে ধুঁয়া আর নিচে শিশুদের খণ্ড-বিখণ্ড দেহ। রক্ত রক্ত! আমরা তখন কী করুম বুঝতে পারছিলাম না। আরো লোক আসার পর যে যেভাবে পারি আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্তা করি। পরে ফায়ার সার্ভিস আসে। পুলিশ আসে।’
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের কর্মকর্তা রাসেল সিকদার জানান, বিকেলে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গেছে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট। বেলুন বিক্রি করার একটি ভ্যানে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। সিলিন্ডার থেকে বেলুনে গ্যাস ভরা হতো। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই ভ্যানের পাশে থাকা চার শিশুর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পরে আরেকটি লাশ উদ্ধার করা হয়। একজন হাসপাতালে মারা গেছে।
সরকারের জরুরি সেবা ৯৯৯-এর পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে আসা এক অ্যাম্বুল্যান্সচালক বলেন, ‘আমাকে ৯৯৯ থেকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা আট থেকে ১০টি অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে চলে আসি। এসে চারজনকে মৃত অবস্থায় দেখি। তাদের দ্রুত ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে।’
সুমন ও শহীদুল নামের দুই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘আমরা এসে পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় দেখেছি। চারজনের লাশ প্রথমে নেয়। পরে আরেকটি খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত অনেক।’
আনিসুর রহমান নামের আরেকজন বলেন, ‘রূপনগরের ১১ নম্বর সড়কে বেলুন বিক্রি করার একটি ভ্যানে সিলিন্ডার থেকে গ্যাস ভরা হচ্ছিল। সেখানে কাঠি দিয়ে খোঁচা দেয় বেলুন বিক্রেতা। সে পানিও দিয়েছিল। ওই বেলুন বিক্রেতা প্রায়ই বেলুন বিক্রি করে। তার সিলিন্ডার থেকে আগেও ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। তবে বিষয়টি স্থানীয় লোকজন গুরুত্ব দেয়নি।’ ওই বেলুন বিক্রেতার নাম জানেন না বলে জানান আনিসুর রহমান।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। তিনি বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে। আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়াতে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন।
নিহত এক শিশুর খালা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে জানান, তাঁর বোনের মেয়ে বাবার কাছে বেলুন কেনার বায়না ধরলে তার বাবা তাকে টাকা দিয়ে বেলুন কিনতে পাঠান। কিছুক্ষণ পরে বিস্ফোরণের শব্দ শুনে এসে মেয়ের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। আরেক নিহত শিশু নূপুরকে বেগুন কেনার জন্য পাঠিয়ের্িছল তার মা।
বস্তিতে কান্নার রোল : যে পাঁচ শিশু নিহত হয়েছে তারা সবাই ‘ফজর আলী মাতবর বস্তির’ বাসিন্দা। ফলে পুরো বস্তিতে কান্নার রোল দেখা গেছে। নিহত ফারজানার ঘরে গিয়ে দেখা গেছে, তার মা নার্গিস আক্তার আহাজারি করছেন। মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার। লোকজন তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই কাজে আসছে না। পাঁচ বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ছিল মেজো। পাশেই আরেকটি ঘরের বাসিন্দা নূপুরও মারা গেছে এ ঘটনায়। গিয়ে দেখা যায়, তার মা সুরমা বেগম পাগলপ্রায়। কাঁদতে কাঁদতে তিনিও মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বস্তিবাসী জানাল, নূপুরের বাবা নূর আলম কারাগারে। তার মা সুমি বাসাবাড়িতে কাজ করে দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছিলেন।
এদের পাশেই নিহত রুবেলের ঘর। রুবেলের দাদি কান্না করে গড়াগাড়ি খাচ্ছিলেন। রুবেলের ছোট ভাই জিয়াদ এক বছর আগে পানিতে ডুবে মারা গেছে বলে তার দাদি জানান। তাদের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে। তাদের বাবা রিকশা চালান।
বেলুনওয়ালার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের : রূপনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে জানান, রাতে বেলুনওয়ালা আবু সাঈদকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় আবু সাঈদ নিজেও আহত হয়েছেন। তাঁকে প্রথমে পঙ্গু হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশি পাহারায় তাঁর চিকিৎসা চলছে। তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। অপরাধজনক নরহত্যা তৎসহ বিস্ফোরক আইনে এ মামলা দায়ের করা হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, মিরপুরের দুয়ারীপাড়া এলাকার একটি বস্তিতে আবু সাঈদ তাঁর এক ভাইয়ের সঙ্গে বসবাস করেন। তিনি চকবাজার থেকে কেমিক্যাল এনে সিলিন্ডারের ভেতর ঢুকিয়ে গ্যাস তৈরি করেন। সেই গ্যাস দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে থাকেন। ওসি জানান, গুরুতর আহত থাকায় আবু সাঈদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৫ জন : গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত আহত অবস্থায় ১৫ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জনই শিশু। এরা হলো জুয়েল (২৯), সোহেল (২৬), জান্নাত (২৫), বোন তানিয়া (৮), ভাই বায়েজিদ (৫), জামেলা (৭), অজ্ঞাতপরিচয় শিশু (৫, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক), মীম (৮), ওজুফা (৯), মোস্তাকিম (৮), মোরসালিনা (৯), নিহাদ (৮), অর্ণব ওরফে রাকিব (১০), জনি (১০)। এই ১৪ জনকে জেনারেল বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সিয়াম নামে ১১ বছর বয়সী এক শিশুকে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের এখানে ১৫ জন আহত অবস্থায় এসেছে, এদের মধ্যে চার-পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর। আমরা তাদের সব ধরনের চিকিৎসা দিচ্ছি।’ তিনি আরো জানান, অজ্ঞাতপরিচয় একটি শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক। জুয়েল ও সোহেলের অবস্থা গুরুতর। দুই ভাই-বোনের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম আছে। অন্যদেরও শরীরে জখম রয়েছে।