মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন নিয়ে সমালোচনা করে ই-মেইল ফাঁসের জেরে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার কিম ডারখ পদত্যাগ করেছেন।
থেরেসা মে বলছেন, স্যার কিমের এই সিদ্ধান্ত ‘গভীর দুঃখের বিষয়।’ এরআগে, রাষ্ট্রদূত মিস্টার ডারখ বলেন, তার জন্য এই দায়িত্ব পালন করে যাওয়া ‘অসম্ভব।’
তাকে পূর্ণ সমর্থন দিতে ব্যর্থ হওয়ায় কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন টোরি নেতৃত্ব প্রত্যাশী প্রার্থী বরিস জনসন।
গত সোমবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, স্যার কিমের সাথে বিষয়টি নিয়ে বোঝাপড়ায় যাবে না যুক্তরাষ্ট্র।
ট্রাম্প প্রশাসনকে ‘অদ্ভুত এবং নিষ্ক্রিয়’ উল্লেখ করে স্যার কিমের ই-মেইল প্রকাশ পাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে ‘একজন মূর্খ ব্যক্তি’ বলে মন্তব্য করেছেন।
পররাষ্ট্র দপ্তরে দেয়া এক চিঠিতে স্যার কিম বলেন, তার অবস্থান নিয়ে বিতর্ক শেষ করতে চেয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘আমি যেভাবে দায়িত্ব পালন করতে পছন্দ করি বর্তমান অবস্থায় সেটি সম্ভব নয়।’
স্যার কিমের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত তার পক্ষে ব্যাপক সমর্থন তৈরি করলেও টোরি নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে থাকা প্রার্থী বরিস জনসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিবিসি’র প্রতিবেদক জেমস ল্যান্ডাল বলছেন, হোয়াইটহলের সূত্রমতে, মঙ্গলবার রাতে টোরি নেতৃত্ব নিয়ে অনুষ্ঠিত বিতর্কে মিস্টার জনসন স্যার কিমকে সমর্থন দিতে অসম্মতি জানানোর পর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
আরেক প্রার্থী জেরেমি হান্ট মিস্টার জনসনকে বারবার প্রশ্ন করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি স্যার কিমকে স্বপদে বহাল রাখবেন কিনা। তবে এ প্রশ্নের কোন উত্তর দেননি তিনি।
তবে এটা স্পষ্ট যে, মিস্টার জনসন বুধবার বিকেলে স্যার কিমের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন।
মিস্টার জনসনের কাছের এক সূত্র জানায়, স্যার কিমের অবদান এবং কঠোর পরিশ্রমের প্রশংসা করেছেন মিস্টার জনসন এবং দাবি করেন যে দুই জনের এই আলাপ উষ্ণ ও আন্তরিক ছিল।
স্যার কিমের পদত্যাগের পর মিস্টার জনসন বলেন, তিনি ছিলেন ‘একজন চমৎকার কূটনীতিক’ এবং ই-মেইল যেই ফাঁস করে থাকুক না কেন সে ‘ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তাদের চরম ক্ষতিসাধন করেছে।’
স্যার কিমের প্রতি তিনি কেন আরো বেশি সমর্থন দেননি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক পরিধিতে টেনে আনা ঠিক নয়।’
ইউরোপ বিষয়ক মন্ত্রী স্যার অ্যালান ডানকান, যিনি কিনা টোরি নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় মিস্টার হান্টকে সমর্থন করেন, তিনি বলেছেন, স্যার কিমকে সমর্থন না করা মিস্টার জনসনের ‘অবমাননাকর অবহেলা।’
‘নিজের স্বার্থের জন্য তিনি আসলে এই দারুণ কূটনীতিককে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন,’ বলেন ডানকান।
জনসনের সমর্থক স্যার মাইকেল ফ্যালন বিবিসির নিউজ নাইটকে বলেন, স্যার কিমের অবস্থান, ‘মঙ্গলবার রাতের বিতর্কের অনেক আগেই’ গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আর তিনি মনে করেন যে, রাষ্ট্রদূত ওই বিতর্ক দেখেননি।
তিনি বলেন, জনসনের বিরুদ্ধে এই সমালোচনা ‘রাজনীতিকীকরণের একটি বাজে প্রচেষ্টা’ এবং তিনি এরইমধ্যে নিশ্চিত করেছেন যে ‘তিনি আমাদের সব কূটনীতিককেই সমর্থন করেন।’
লেবার নেতা জেরেমি করবিন বলেন, জনসন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘মধুর বাণিজ্য চুক্তি’ করতে চেয়েছিলেন এবং স্যার কিমের প্রতি তার সমর্থন হীনতা প্রমাণ করে যে, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না তিনি।’
টোরি এমপি এবং পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষের পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান টম টুগেন্ডহাট এক টুইটে বলেন, ‘নেতারা তাদের কর্মীদের সমর্থন করেন। তারা তাদের উৎসাহ দেন এবং যখন তার ব্যর্থ হয় তখন তাদের রক্ষা করেন।’
আরেক টোরি নেতৃত্ব প্রত্যাশী প্রার্থী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিস্টার হান্ট বিবিসিকে বলেন, স্যার কিম ‘তার দায়িত্ব পালন করছিলেন’ এবং তার পদত্যাগ ‘ব্রিটিশ কূটনীতির একটি কালো দিন।’
মে বলেন, স্যার কিমের প্রতি পুরো মন্ত্রীসভার সমর্থন রয়েছে এবং ব্রিটেনের প্রতি তার সারা জীবনের অবদানের জন্য ‘কৃতজ্ঞতায় ঋণী করেছেন।’
তিনি বলেন, সরকারি কর্মীদের ‘পূর্ণ এবং আন্তরিক মতামত’ দেয়ার অধিকার থাকা উচিত।
বিবিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদক জেমস ল্যান্ডাল তার বিশ্লেষণে প্রশ্ন তোলেন, বরিস জনসনের কারণেই কি এটা হয়েছে? সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর গত রাতের বিতর্কে স্যার কিমকে সমর্থন না দেয়ার ব্যর্থতাই কি রাষ্ট্রদূতের পদত্যাগের পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে?
স্যার কিম যেহেতু এবিষয়ে জনসম্মুখে কথা বলছেন না তাই এবিষয়ে অন্যদের বক্তব্যের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
হোয়াইট হলের নির্ভরযোগ্য সূত্রের মতে, মিস্টার জনসনের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা না করা এবং স্যার কিমকে সমর্থন না দেয়ার সিদ্ধান্তই মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
আপনি যদি কূটনীতিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া দেশে প্রতিকূলতার মুখে পড়েন তাহলে আপনার লন্ডনের সমর্থন দরকার হবে। আর সেখানে আপনার ভবিষ্যৎ বস যদি আপনাকে তা দিতে অসম্মতি জানায় তাহলে সে ইঙ্গিত আপনাকে বুঝতে হবে।
আর তাই নিশ্চিতভাবেই গত রাতের বিতর্কে ওয়াশিংটনে থাকা আমাদের কর্মীর প্রতি মিস্টার জনসনের টানা ছয় বার সমর্থন না দেয়ার সিদ্ধান্ত আসার পর তার বিরুদ্ধে ওয়েস্টমিনস্টার এবং হোয়াইটহলে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
মিস্টার জনসনের সমর্থকরা এর বিপক্ষে অনেক ধরণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকে আবার এই পদত্যাগকে রাজনীতিকীকরণ করার জন্য মিস্টার হান্টের সমর্থকদের দোষারোপ করছেন।
অনেকে আবার বলেছেন যে, স্যার কিমের সাথে বোঝাপড়ায় না যেতে ট্রাম্পের ঘোষণার পর এবং বিতর্কের আগেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সমস্যা হচ্ছে ওয়েস্টমিনস্টারে কেউ কেউ এই বক্তব্যকে বিশ্বাসও করছেন।
হাউস অব কমন্সে, থেরেসা মে এমপিদের বলেন যে, “চাপ রয়েছে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা রক্ষার দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়া উচিত।”
তিনি আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন তা আন্দাজ করা মোটেও কঠিন নয়।
কূটনীতি সার্ভিসের প্রধান স্যার সিমন ম্যাকডোনাল্ড বলেন, তার কর্মজীবনে প্রথমবার তিনি দেখছেন যে, একজন রাষ্ট্রপ্রধান একজন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে সমর্থন দিতে অসম্মতি জানাচ্ছেন।
তিনি এই ফাঁসের ঘটনাকে ‘বিদ্বেষপরায়ণ’ বলে উল্লেখ করে স্যার কিমের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো।’
রিপাবলিকান সিনেটর এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থক লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, স্যার কিম রাষ্ট্রদূত হিসেবে “অসামান্য অবদান ‘রেখেছেন এবং তার পদত্যাগ’একটি হতাশাজনক মুহূর্ত।
‘একজন রাষ্ট্রদূতকে বিপদগ্রস্থ হওয়ার ভয়হীনভাবে তার সরকারের সাথে কথা বলার অধিকার থাকতে হবে,’ তিনি বলেন।
স্যার কিমের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি এবং সিভিল সার্ভিসের প্রধান স্যার মার্ক সেডউইল বলেন, পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে তিনি যা বোঝেন সেটি হচ্ছে ‘এটা খুবই দুঃখজনক বিষয় যে, মারাত্মক বিশ্বাস ভঙ্গের পর আপনাকে এই অবস্থানে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।’
ক্যাবিনেট অফিস মিনিস্টার ডেভিড লিডিংটন বলেন, এই পরিস্থিতির কারণে তিনি ‘ক্ষুব্ধ’ এবং এর ফলে সিভিল সার্ভিসের উচ্চ পর্যায়ে ‘বেশ বড় ধরণের আঘাত তৈরি হয়েছে।’
সিভিল সার্ভিসের সাবেক প্রধান লর্ড ও’ডনেল বিবিসিকে বলেন, মিসেস মে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে স্যার কিমের উত্তরসূরি নির্বাচন করা হবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো আজ সকালে এই ভেবে ঘুম থেকে উঠবেন যে, যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত কে হবে সে বিষয়ে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা আছে তার।
তবে স্যার কিমের সার্ভিসের অবসান ট্রাম্পের টুইটারের রঙিন মন্তব্যের কারণে হয়নি বরং জনসম্মুখে স্যার কিমের সাথে কাজ না করার ঘোষণার কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে।
এই প্রভাবও বেশ সাথে সাথেই পাওয়া গেছে। একটি ভোজের দাওয়াত থেকে স্যার কিমকে বাদ দেয়া হয়। পরে মিনিস্টার লিয়াম ফক্সের সাথে একটি অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে পারেননি তিনি।
এটা পরিষ্কার ছিল যে, তাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়েছে এবং একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার প্রবেশাধিকার গুলোই মুখ্য। এটা ছাড়া তার পক্ষে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।
আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, এটা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বিশেষ সম্পর্কে কখনোই সমতা ছিল না, এটা কখনোই দুই সমকক্ষ পক্ষের সম্পর্ক ছিল না কিন্তু এখন এটা পুরোপুরি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র জানে যে, ব্রিটেন আন্তর্জাতিকভাবে একা হয়ে পড়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকেই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ ঘটনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই সুযোগটিকেই নির্দয় ভাবে ব্যবহার করেছেন।
ফাঁস হওয়া ওই ই-মেইলে স্যার কিম বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি না যে এই প্রশাসন ক্রমে আরো স্বাভাবিক; কম অকার্যকরী; কম অনিশ্চিত; কম বিভক্ত হতে যাচ্ছে; বরং এটা কূটনৈতিকভাবে অদ্ভুত এবং নিষ্ক্রিয়।”
২০১৭ সালের ওই ই-মেইলে বলা হয়, হোয়াইট হাউসে “অন্তর্ঘাত ও বিশৃঙ্খলার” গুজব বেশিরভাগই সত্য।
সরকার এই স্মারকলিপি প্রকাশের ঘটনায় অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করেছে এবং পুলিশকেও তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।