জীবনের গোধূলিবেলায় এসে অনেককেই বাস্তুহারা হতে হয়। এটা নির্মম একটা সত্যি, যা মানতে বড়ই কষ্ট হয়। নিজের বাড়িতে থেকে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েও,বৃদ্ধ বয়সে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় অন্যের ‘ওল্ড এজ হোম’-এ অথবা বৃদ্ধাশ্রমে। পৃথিবী যত আধুনিক হচ্ছে এমন হতভাগা মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে ততই বাড়ছে সমাজে।
সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখার পূর্বে পর্যন্ত মায়ের গর্ভকে জগৎ বলে বাস করে থাকেন নাড়ী ছেড়া ধন মায়ের সন্তান। মা-বাবা ছাড়া পৃথিবী দেখা কল্পনা করা অসম্ভব। মায়ের প্রসবের পূর্বে পর্যন্ত গর্ভে থাকা সন্তানদের নিয়ে চলাফেরা উঠতে বসতে মা’র কত ব্যথা, কত কষ্ট, তা শুধু মায়েই জানে। সন্তান প্রসবের সময় কত যে কষ্টকর পৃথিবীর সব ব্যথা আর যন্ত্রণা যেন মায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। এমন কি মৃত্যু ঝুঁকির দুয়ার পর্যন্ত চলে যায়, সীমাহীন কষ্টের ফলে সন্তান প্রসবে ভূমিষ্ঠ হন নব জাতক প্রিয় সন্তান।
স্নেহভরা প্রিয় শিশু সন্তানের আদরমাখা মুখখানা দেখে মা সব ব্যথা যেন ভুলে যেতে থাকেন। এটাই হল মমতাময়ী দরদী মা। তেমনিভাবে সন্তানের জন্য পিতার মায়া দরদ কোন ভাবেই কমতি নেই। সন্তানদের জন্য পিতা বটবৃক্ষের ছায়ার মতো শ্রেষ্ঠ অভিভাবক হয়ে থাকেন। মাতার শিক্ষা দীক্ষা ও পিতার দুর্লভ শ্রমেই সন্তান লালিত পালিত হয়ে বেড়ে উঠে। লালন-পালনে থাকেনা তাদের কোন স্বার্থ, থাকে নিঃস্বার্থ ভালবাসা। এমনও সন্তান রয়েছে, যে সন্তানেরা ধীরে ধীরে বড় হয়, প্রতিষ্ঠিত পর্যায়ে পৌঁছেন, উঁচু ভবন নির্মাণ করেন, তখন মা-বাবাকে নিয়ে দুর্ভাগা সন্তানেরা দুর্ভাবনায় পড়ে যায়। বিলাসবহুল বাড়িতে সবার ঠাঁই হলেও গর্ভধারণী মা ও জন্মদাতা পিতার স্থান হয় না, যে মা ছাড়া পৃথিবীর মুখ দেখা অসম্ভব, সে মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই মেলে। কোন কোন সন্তান আছে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দেশের বাইরে সেটেল হয়ে চলে যায় বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে। এটাই কি সভ্য মানুষের কাজ? পিতা-মাতা তখন সন্তানদের বোঝা হয়ে যায়। প্রাসাদের উঁচু থেকে নিচু তলার কামরায় এমন কি কোন কোণে গুঁজে থাকার ঠাঁই মেলে না মা-বাবার। বৃদ্ধাশ্রমই যেন জীবনের বেঁচে থাকার শেষ ঠিকানা হয়ে যায়। যে বয়সে সন্তান পরিবার তাদের পাশে থাকার কথা সে বয়সে তারা বৃদ্ধাশ্রমে। একি নিষ্ঠুরতা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বয়সে তারা চান পরিবারের সান্নিধ্য ও একটু সেবা। কিন্তু অনেকেই মা-বাবাকে সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, এটা অনুচিত। মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও আল হাদিসে পিতা-মাতার প্রতি ভাল আচরণ করার কথার বলেছে। হাদিসে বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত। আসুন, মা-বাবার প্রতি যত্নবান হই।
বৃদ্ধাশ্রম। শব্দটি শুনতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে একটি আবাসিক বাড়ি। যেখানে পরিবার পরিত্যক্ত বৃদ্ধ মানুষেরা একটি আশ্রয় খুঁজে পায়।
শাহেরা বেগম ( ছদ্ম নাম)। বয়স আনুমানিক ৯৫ বছর। স্বামী ছিলেন এক সময়ের সাবেক ক্ষমতাশালী পুলিশ সুপার (এসপি)। স্বামী সন্তানদের নিয়ে খুব ভালোভাবেই চলছিল শাহেরার সংসার। সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করে সুন্দর ভবিষৎ গড়ে দিয়েছিলেন মা-বাবা। বেশ কয়েক বছর আগে স্বামী চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এরপর থেকেই সংসারে বোঝা হয়ে গিয়েছিলেন মা শাহেরা বেগম। সন্তানদের কাছে এতটাই অবহেলিত ছিলেন মা শাহেরা যে, সন্তানেরা তাকে মুরগির খোঁয়াড়ে রেখেছিল। মুরগীর সঙ্গে থাকা-খাওয়া, ঘুমানোই ছিল শাহেরার জীবন। এখন তার আশ্রয় হয়েছে একটি বৃদ্ধাশ্রমে।
এমন অসংখ্য বৃদ্ধ/বৃদ্ধা রয়েছেন যারা প্রত্যেকই ছেলে-মেয়ের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে নিজ ঘর সংসার থেকে বিতাড়িত। এখন তাদের ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।
একটি মা মাকড়সা কয়েকটি বাচ্চা প্রসব করলো, জন্ম নেওয়ার পর বাচ্চারা তার মার মাংস আস্তে আস্তে খেতে লাগলো,এক পর্যায়ে মার শরীরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো, আর ঐ দিকে মার মাংস খেয়ে বাচ্চারা বড় হতে লাগলো, এটাই হলো “মা” যে তার সবকিছু শেষ করে দিয়ে সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখেন।
পিতামাতার সম্মানের প্রতি পবিত্র কুরআনে ও মহানবী (সঃ) গুরাত্বরোপ করেছেন এরপরও কি আমরা উনাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পেরেছি? যদি সম্মান আর সঠিক ভালোবাসা দিতে পারতাম তাহলে তাদের স্হান বৃদ্ধাশ্রমে হতো না। সবাইকে নিয়ে একসাথে বসবাস করার একটি সুন্দর নাম পরিবার।
সন্তানদের নিয়ে তিল তিল করে একটি পরিবার গড়ে তুলেন পিতা-মাতা। সকলের সুখের জন্য যেই সংসারটি শত কষ্ট আর আঘাতের মাধ্যমে গড়ে তুলেন মা-বাবা, একটা সময় সেই সুখের সংসারে তাদের আর স্হান হয়না! তাদের স্হান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। যেই বয়সে সন্তান আর নাতী-নাতনীদের ভালোবাসায় থাকার কথা সেই বয়সে উনারা জীবন যাপন করেন আবদ্ধ এক নিরব পরিবেশে। বর্তমান সময়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবার গুলো ভেঙে যাচ্ছে, বাড়ছে প্রবীনদের প্রতি অবহেলা আর বঞ্জনা। শুধু বঞ্চনাই স্বার্থের কারনে কখনো কখনো সন্তানরা বৃদ্ধ পিতামাতাকে শারীরিকভাবে আঘাত করছে, কখনো হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য ঘটনার জম্ম দিচ্ছে ছেলেমেয়েরা!
একটা সময় মা বাবাকে খুবই প্রয়োজন ছিলো আজ আর প্রয়োজন নেই, তাই তাদের আশ্রয়স্হল হলো আবদ্ধ বৃদ্ধাশ্রমে। একদিন আপনিও বৃদ্ধ হবেন,বয়সের বাড়ে নতজানু হয়ে যাবেন,তখন আপনার স্হান কোথায় হবে একবার ভেবেছেন কি? বৃদ্ধাশ্রম কিংবা রাস্তার পাশ যেন আপনার ঠিকানা না হয়।
বৃদ্ধাশ্রম কিংবা রাস্তার পাশে আমাদের ঠিকানা হোক এটা আমরা কেউ চাইনা। আমাদের অঙ্গিকার হোক, যেই মা বাবা আমাদের নিজের শরীর ক্ষয় করে লালনপালন করেছেন, আমরাও তাদেরকে সেরকম ভালেবাসা দিয়েই সেবাযত্ন করবো।
কারো মা বাবার ঠিকানাই যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়, বৃদ্ধাশ্রমের একটি সিটও যেন আর কোন মায়ের জন্য বরাদ্ধ না হয়।
লেখকঃ আবুল কালাম আজাদ, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।