মোহাম্মদ আলী আশরাফ, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
খুলনার বিখ্যাত খাবার কি? খুলনার চুকনগরের চুই ঝালের আব্বাস হোটেলের খাসির মাংস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পুত্র জনাব জয়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র জনাব তারেক জিয়া সহ এমন কোন বড় ভিআইপি নেই যারা এই মাংসের স্বাদ গ্রহণ করেননি। এমনকি কয়েকমাস আগেই নিজে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে রান্না করে খাইয়ে এসেছেন। এ কথাটি বলছিলেন আব্বাস হোটেল এর অন্যতম এক কর্ণধর আব্দুস সেলিম যিনি বর্তমানে চুকনগরের এই দোকানটির মূল দায়িত্বে আছেন।
আঃ সেলিম হলেন মরহুম আব্বাস সাহেবের ছোট ছেলে। উনার আরো দুই ভাই এই ব্যাবসা করছেন তারা হলেন আঃ জলিল এবং আঃ হালিম। এখানে বাংলাদেশের চিত্র জগতের বলতে গেলে সব অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্রিকেটার, ফুটবলার সহ যতো কৃতি মানুষ আছে প্রায় সবারই পায়ের ধুলো পরেছে এই দোকানটিতে। এখান থেকে প্রতিমাসে ই বিশ্বের আট থেকে দশটি দেশে এই চুইঝালের রান্না করা মাংস পাঠানো হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ও মানুষ মোবাইল ফোনের অর্ডারের মাধ্যমে এখান থেকে চুইঝালের মাংস কিনে নেন। বিশেষ করে ঢাকা থেকে অনেক মানুষ এখানে অর্ডার দিয়ে চুইঝালের মাংস কিনে নেন।
আব্দুস সেলিম বলছিলেন প্রতিমাসে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ টি অর্ডার থাকে ঢাকা থেকে। যেখানে চুই ঝালের মাংস ডেলিভারি করা হয়। চুকনগর খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার অন্তর্গত।ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নে চুকনগর বাজার অবস্থিত। চুকনগর খুলনা শহর থেকে প্রায় ৩২ কি,মি পশ্চিমে ভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত এবং ভারতীয় সিমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চল। স্টিলের বড় গামলায় ভর্তি করা তেল চুপচুপে লালচে খাসির মাংসের মধ্যে হাসিমুখে উঁকি দিচ্ছে আস্ত রসুন আর ইঞ্চি দেড়েক লম্বা করে কাটা চুই।
তেল-নুন-মসলায় জারিত মাংসের ঝোল সাদা ধোঁয়া ওঠা ভাতের ওপর ছড়িয়ে দিলে যে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, তার তুলনা এই নশ্বর পৃথিবীতে বিরল। ঝোলে মাখা ভাতের প্রথম গ্রাস যখন আপনার জিব স্পর্শ করবে, চুইয়ের নরম ঝাল তখন আচ্ছন্ন করে রাখবে স্বাদগ্রন্থি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ হয়ে যাবে অমৃতের পরশে। এমনি তুলনাহীন খুলনার আব্বাসের চুই ঝালের খাসির মাংস। খুলনা ভ্রমণের শুরুতেই আলি আশরাফ স্যারের মুখে জেনেছিলাম আব্বাস হোটেলের চুইঝাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংসের সুখ্যাতির কথা।
গর্বভরে সবাই বলেছিল, ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারে গিয়ে যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে আব্বাসের হোটেল। আমি এবং ইউসুফ উপস্থিত হলাম সেখানে। প্রথমেই জানা গেল, শুধু সাদা ভাত আর খাসির মাংস ছাড়া এই হোটেলে অন্য কোনো খাবার রান্না হয় না। আব্বাস হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চুকনগরের বাসিন্দা আব্বাস আলী মোড়ল। খুলনার রেস্টুরেন্ট–জগতে কিংবদন্তিতুল্য আব্বাস আলী আনুমানিক ৭৫-৮০ বছর আগে ভারতের মাদ্রাজ থেকে রান্না শিখে ফিরে আসেন নিজের এলাকায়। পরে তাঁর সঙ্গে নিজস্ব রান্নার কৌশলের মিশেল ঘটিয়ে এ অঞ্চলের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ইতিহাসের জন্ম দেন তিনি। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রথম থেকে তিনি নিজেই রান্না করতেন। মজাদার রান্নার কারণে অল্প দিনেই সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আব্বাস আলী মোড়ল এর। পরবর্তী সময়ে তাঁর তিন ছেলেকে শিখিয়ে দেন রান্নার কৌশল। ২৭ বছর আগে আব্বাস আলী মোড়লের মৃত্যু হলে হোটেলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ছেলেরা।
সহকর্মী সঙ্গে থাকলেও আব্বাস আলীর তিন ছেলে আবদুল জলিল মোড়ল, আবদুল হালিম মোড়ল ও মো. সেলিম মোড়ল পালাক্রমে মূল রান্নার কাজে অংশ নেন। এখন তিন ভাইয়ের সন্তানেরাও এসেছে হোটেল পরিচালনায়। চুকনগর বাজারের মূল রেস্টুরেন্টের বিপরীতে আছে ‘আব্বাস হোটেলে’–এর আরও একটি শাখা। এ ছাড়া খুলনা জিরো পয়েন্টেও আছে আর একটি শাখা। মোট তিনটি শাখায় সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে রাত ২টা পর্যন্ত প্রতিদিন খাবার খেতে পারবেন। শুধু দুই ঈদে পাঁচ দিন করে বন্ধ থাকে হোটেলটি। এখানে মাংস বিক্রি হয় পিস হিসেবে।
প্রতি পিস মাংস ১৩০ টাকা, ভাত প্রথমবার ফ্রী এবং পরবর্তী প্রতি প্লেট ভাতের জন্য গুনতে হবে ১০ টাকা করে। রেস্টুরেন্টের সামনে সারি করে রাখা ব্যক্তিগত গাড়ি আর মোটরসাইকেলের বাঁধা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকাটাই এক যুদ্ধ। পরের যুদ্ধ টেবিল খালি পাওয়া। এত যুদ্ধকে কোনো যুদ্ধই মনে হয় না মাংস মুখে দিলে। এ জন্য প্রতিদিন খুলনার বিভিন্ন এলাকা তো বটেই, দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন ভোজনরসিকরা। অনেকে যাওয়ার সময় চুইঝালে রান্না করা মাংস বেঁধে নিতে ভোলেন না প্রিয়জনের জন্য। কথায় কথায় সেলিম জানালেন, প্রতিদিন পশু ডাক্তার দিয়ে ৭০-৮০ টি খাসি পরীক্ষা করিয়ে তবে সেই খাসিকে জবাই করে মাংস রাখেন তাঁরা। তাঁদের প্রয়োজনীয় অংশ রেখে পায়া, মাথা, ভুঁড়িসহ অন্য অংশ পাঠিয়ে দেন স্থানীয় বাজারে। সকাল সাতটা থেকে প্রতিদিন কয়েকবার চলে রান্নার আয়োজন।
যারা ঝাঁ চকচকে রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে অভ্যস্ত, তাদের জন্য আব্বাস হোটেল মোটেও সুখকর পরিবেশ দিতে পারবে না। সাধারণ মানের হাত ধোয়ার জায়গা, খাবার পরিবেশনসহ প্রতিটি ধাপ খুব সাদামাটা। কিন্তু এই সাধারণ থেকেও আব্বাস হোটেল হয়ে উঠেছে খাদ্যপ্রেমীদের জন্য অসাধারণ স্বাদের উৎসস্থল। চুইঝাল মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোয় মসলা হিসেবে খুব জনপ্রিয়। চুইগাছ দেখতে পানের লতার মতো। পাতা কিছুটা লম্বা ও পুরু। পাতায় ঝাল না থাকলেও এর কাণ্ড ও ডালের স্বাদ ঝাল। মূলত গরু, খাসি, হাঁস ও মুরগির মাংস, মাছ, সবজিসহ যেকোনো ঝোলজাতীয় রান্নায় মসলা হিসেবে চুইগাছের কাণ্ড বা লতার ব্যবহার করা হয়। দেড় থেকে দুই ইঞ্চি টুকরা করে কেটে কাণ্ড বেশি মোটা হলে মাঝখান দিয়ে ফেড়ে ২, ৪ বা ৬ টুকরা করে খাবার রান্নার সময় যোগ করতে হয়।
রান্নায় চুইয়ের ব্যবহারে খাবারে কিছুটা ঝাল স্বাদ বাড়ে। আর সেই সঙ্গে রান্নায় আলাদা সুঘ্রাণ তৈরি হয়। এর কাণ্ড, শিকড়, পাতা, ফুল ও ফল ভেষজ গুণসম্পন্ন। চুই গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, খাবারের রুচি বাড়ায়, রক্তস্বল্পতা দূর করে, ক্ষুধামান্দ্য দূর করে, শরীরের ব্যথা সারায়, কাশি, কফ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া সারাতে কার্যকর।