করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সাত দিনের বিশেষ বিধি-নিষেধ আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর গতকাল রবিবার গণপরিবহন নিয়ে নৈরাজ্যকর এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্যবিধি মানার সামান্য নমুনা দেখা যায়নি কোথাও। গণপরিবহনে যাত্রীদের বেশির ভাগ ছিল মাস্কবিহীন। বাসের কোনো সিট খালি রাখা হয়নি। উল্টো দাঁড় করিয়েও যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে। আর যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়েছে দ্বিগুণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি।
স্বাস্থ্যবিধি, অতিরিক্ত ভাড়া—এসব দেখার জন্য কোথাও ছিল না কোনো পর্যবেক্ষকদল। দূরপাল্লার বাসে টিকিটের জন্য ছিল হুড়াহুড়ি। একই অবস্থা দেখা গেছে লঞ্চেও। উপচে পড়া ভিড়, স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করা, সঙ্গে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ফেরিঘাটে দেখা গেছে ঘরমুখী মানুষের বিপুল স্রোত। এসবের মধ্যেই গতকাল সন্ধ্যায় বৈরী আবহাওয়ার কারণে সদরঘাট থেকে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বিআইডাব্লিউটিএ।
ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতউল্লা জানিয়েছেন, আজ সোমবার থেকে পরিবহন বন্ধ থাকছে। সরকারি সিদ্ধান্ত পেয়ে তাঁরা এরই মধ্যে তা মালিকদের জানিয়ে দিয়েছেন। লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহাবুবউদ্দিন বীরবিক্রম জানিয়েছেন, বিশেষ নিষেধাজ্ঞার সময় লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে।
আজ ৫ এপ্রিল সকাল ৬টা থেকে আগামী ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত লকডাউনের আদলে বিশেষ এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছে।
গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে চলাচল করা সব কটি বাসে দেখা যায়, বাসচালক, সহকারী, যাত্রী, কারো মুখে মাস্ক নেই। আর প্রতি আসনে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। ফাস্টটেন, প্রজাপতি, বিহঙ্গ, ক্যান্টনমেন্ট, আকাশ, অছিম ও ক্লাসিক পরিবহনের বাসগুলোর ৪০ আসনের বাইরে আরো অন্তত ২০ জন দাঁড় করিয়ে নেওয়া হয়েছে। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে গাবতলীর ভাড়া ১০ টাকা হলেও যাত্রীদের কারো কাছ থেকে ২০ টাকা আবার কারো কাছ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে।
রাজধানীর সব বাস টার্মিনালে দেখা গেছে উপচে পড়া ভিড়। কোথাও পা ফেলার জায়গা ছিল না। দূরপাল্লার বাসগুলো করা হয়নি জীবাণুমুক্তকরণ। যাত্রীদের হাতে দেওয়া হয়নি হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মুখে মাস্ক দেখা যায়নি কোনো যাত্রীর। বাসের সব আসন ভর্তির পর মাঝখানের চলাচল করার স্থানে মোড়া পেতে যাত্রী পরিবহন করা হয়েছে।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমার পরিবহন অতিরিক্ত ভাড়া নেয়নি আর আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের বাস চালিয়েছি।’
গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালীর পরিবহন কাউন্টারগুলোর ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাঁরা কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি।
গতকাল রাজধানীর মালিবাগ থেকে নতুন বাজার যাওয়ার জন্য তুরাগ বাসে ওঠেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রোমানা রুমকি। ওঠার সময় তিনি সরকারি নির্দেশনা অনুসারে বাসে ৫০ শতাংশ যাত্রী দেখলেও বাড্ডায় এসে দেখলেন বাসটি অতিরিক্ত যাত্রী নিচ্ছে। রোমানা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব সময় দায় তো আমাদেরই। ভাড়া বাড়াল, সেখানে তারা আমাদের কোনো প্রতিনিধি রাখেনি। এখন বেশি ভাড়া দিচ্ছি; কিন্তু তাতে আমরা কোথায় সুরক্ষা পাচ্ছি! বাস তো ঠিকই বেশি যাত্রী তুলতেছে!’
রামপুরা, মহাখালী, বাড্ডা, কল্যাণপুর, গাবতলী, মিরপুর এলাকার ভিক্টর ক্লাসিক, রাইদা, অনাবিলসহ আরো কয়েকটি বাস ঘুরে দেখা গেছে, এসব বাস অতিরিক্ত যাত্রী বহন করছে। আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে যাত্রীদের মধ্যে নেই সামান্যতম সচেতনতা।
এদিকে বাসের ভাড়া বাড়ানোসহ অন্যান্য বিধি-নিষেধ জারি করলেও তা তদারকিতে বিআরটিএর কোনো টিমকে মাঠে দেখা যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় দেখা যায়।
অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কেন বাড়ি যাচ্ছেন জানতে চাইলে হাজারীবাগের বাসিন্দা জালাল বলেন, ‘সরকার সাত দিনের লকডাউন দিছে। এই সাত দিনের পর যে আরো কয় সাত দিন আসে, আল্লাহই জানেন। গতবার তো দুই সপ্তাহ কইতে কইতে বছর পার করে দিছে। তাই বাড়ি যাইতাছি।’
পটুয়াখালী যাবেন জামিল। তিনি রায়েরবাজার এলাকায় চায়ের দোকান চালান। বলেন, ‘আমরা যারা ছোট দোকানদারি করি, তারা পুলিশের যন্ত্রণায় টিকতে পারি না। যারা চাকরি করে তারা না হয় থাকল, আমরা ঢাকায় থাইকা করুম কী!’
ট্রেনের যেসব যাত্রী অগ্রিম টিকিট কেটেছিল, তাদের টিকিট ফেরত নেওয়া হয়নি। আবার গতকাল বিকেলে কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিটপ্রত্যাশী যাত্রীদের ব্যাপক ভিড়ও ছিল। টিকিট কাটার লাইন কাউন্টার থেকে ভবনের বাইরে সড়ক পর্যন্ত চলে আসে। অনেকেই মূল গন্তব্যের টিকিট না পেয়ে বিমানবন্দর স্টেশনের টিকিট নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েছে। যাত্রীরা বলছে, ট্রেনে উঠে পড়লে মাঝপথে নামাতে পারবে না। তখন প্রয়োজনে অতিরিক্ত জরিমানা দিয়ে হলেও ট্রেনে টিকিট মিলবে। সব কিছু মিলিয়ে গতকাল বেশির ভাগ ট্রেনই অর্ধেকের বেশি যাত্রী নিয়ে কমলাপুর থেকে ঢাকা ছেড়েছে।
টিকিট বুকিং সহকারী সুলতানা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব আন্ত নগর ট্রেনের টিকিট শেষ হয়ে গেছে। তবু বাইরে যাত্রীদের চাপ আছে। অনেকে আবার টিকিট ফেরত দিতে এসেছেন। সব মিলিয়ে ভিড় দেখা যাচ্ছে।’
জানা যায়, যেসব যাত্রী ৫, ৬ ও ৭ এপ্রিলের টিকিট অগ্রিম কেটেছিল, তাদের শতভাগ মূল্য ফেরত দেওয়া হবে।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গতকাল শিমুলিয়া ঘাট ঘুরে দেখা যায়, লকডাউনের খবরে সকালের দিকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌ রুটে যাত্রীদের ঢল নামে। বেশির ভাগ যাত্রীই ছিল ঢাকামুখী। তারা লঞ্চে করে শিমুলিয়া ঘাটে এসে বাসস্টেশনের দিকে ছুটছিল। এ কারণে শিমুলিয়ামুখী লঞ্চগুলোতে যাত্রীর ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, দুপুরের পর ভিড় উপচে পড়ে। বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে প্রতিটি নৌযানে। বাড়তি ভাড়া নির্ধারণের ফলে লঞ্চে যাত্রীপ্রতি ভাড়া নেওয়া হয় ৫৫ টাকা এবং স্পিডবোটে ভাড়া নেওয়া হয় ২০০ টাকা। তার পরও আগের চেয়ে বেশি যাত্রী নৌযানগুলোতে। কেউই মানছিল না স্বাস্থ্যবিধি। এদিকে উভয় ঘাটেই যানবাহনের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।
মানিকগঞ্জ থেকে আঞ্চলিক প্রতিনিধি জানান, গতকাল ফেরিগুলোতে তিলধারণের ঠাঁই ছিল না, ঘরমুখী জনস্রোত। ঘাটে পণ্যবাহী ট্রাকের চাপ থাকলেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাত্রীবাহী বাস ও ছোট গাড়ি ফেরিতে আগে পারাপার করা হয়।