মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ  

দুনিয়াবি কষ্টগুলো এক ধরনের পরীক্ষা। আল্লাহ কখনো সুখ-শান্তি দিয়ে পরীক্ষা করেন, আবার কখনো রোগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো দিয়ে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমাদের কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৩৫)

ইবনে আব্বাস (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ভালো-মন্দের মাধ্যমে পরীক্ষা করার অর্থ হলো কষ্ট-সুখ, সুস্থতা-অসুস্থতা, সচ্ছলতা-দরিদ্রতা, হালাল-হারাম, আনুগত্য-অবাধ্যতা, হিদায়াত-পথভ্রষ্টতা প্রভৃতির মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাদের পরীক্ষা করে থাকেন।’ (তাফসিরে তাবারি : ১৮/ ৪৪০)

রোগের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়

রোগব্যাধি মুমিনের জীবনকে গুনাহমুক্ত করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমানের ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আপতিত হয়, এমনকি তার দেহে যে কাঁটা ফোটে, এসবের বিনিময়ে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৬৪১; মুসলিম, হাদিস : ২৫৭৩)

রোগে সওয়াব ও মর্যাদা বৃদ্ধি

রোগের কষ্টে ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে মুমিন বান্দার নেকি অর্জিত হয় এবং মহান আল্লাহ রোগীকে এমন মর্যাদা দান করেন, যা সে আমলের মাধ্যমে অর্জন করতে সক্ষম ছিল না। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এমন মর্যাদা নির্ধারিত থাকে, যা সে তার আমলের মাধ্যমে লাভ করতে সক্ষম ছিল না। তখন আল্লাহ তার দেহ, সম্পদ অথবা তার সন্তানকে বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর তাকে সেই বিপদে ধৈর্য ধারণের সক্ষমতা দান করেন। অবশেষে তাকে সেই মর্যাদায় পৌঁছে দেন, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল।’ (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২২৩৩৮; আবু দাউদ, হাদিস : ৩০৯০)

রোগের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি লাভ

অসুস্থ ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। ফলে সে আখিরাতে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে পারে। একবার আল্লাহর রাসুল (সা.) আবু হুরায়রা (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে একজন জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখতে গেলেন। তিনি রোগীকে বলেন, ‘সুসংবাদ গ্রহণ করো! কেননা মহান আল্লাহ বলেন, ‘এই (রোগ) আমার আগুন, যা আমি দুনিয়াতে আমার মুমিন বান্দার ওপর চাপিয়ে দেই, যাতে আখিরাতের আগুনের পরিপূরক হয়ে যায়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৭০)

রোগ জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম

আল্লাহ রোগব্যাধি দিয়ে মুমিন বান্দাকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। বান্দা যদি এই পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম হয়, তাহলে দুনিয়ার এই কষ্টের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে আখিরাতে সম্মানিত করেন এবং তাকে এত বিশাল পুরস্কার প্রদান করেন যে দুনিয়ার সুস্থ ব্যক্তিরা নিজেদের রোগ না হওয়ার জন্য আক্ষেপ করবে। জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন বিপদে পতিত ব্যক্তিদের যখন প্রতিদান দেওয়া হবে, তখন (পৃথিবীর) বিপদমুক্ত মানুষেরা আফসোস করে বলবে, হায়! দুনিয়াতে যদি কাঁচি দ্বারা তাদের শরীরের চামড়া কেটে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হতো!’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪০২)

কবরের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভ

মহান আল্লাহ মুমিন বান্দাকে এমন কিছু রোগ দিয়ে থাকেন, যে রোগে মৃত্যুবরণকারী বান্দাকে কবরের আজাব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সুলাইমান ইবনে সুরাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পেটের অসুখ যাকে হত্যা করেছে, তাকে কবরের শাস্তি দেওয়া হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৬৪)

কখনো রোগ না হওয়া জাহান্নামি হওয়ার লক্ষণ

কখনো অসুখ-বিসুখ না হওয়া জাহান্নামি হওয়ার লক্ষণ। কারণ যার অসুখ হয় না, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন না—এটাই ধরে নিতে হবে। ফলে আখিরাতে সে জাহান্নামি হবে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘একজন গ্রাম্য লোক আগমন করলে নবী (সা.) বলেন, তোমার কি কখনো উম্মু মিলদাম (এক ধরনের জ্বর) হয়েছে? লোকটি বলল, উম্মু মিলদাম আবার কী? তিনি বলেন, এটা চামড়া ও গোশতের মধ্যকার তাপমাত্রা (জ্বর)। সে বলল, না। নবী (সা.) বলেন, তোমার কি মাথাব্যথা হয়? সে বলল, মাথাব্যথা আবার কী? তিনি বললেন, এক ধরনের বাতাস, যা মাথায় প্রবেশ করে এবং শিরা-উপশিরায় আঘাত হানে। সে বলল, এটা আমার হয় না। এরপর লোকটি যখন উঠে দাঁড়াল, নবী (সা.) তখন বলেন, যে ব্যক্তি কোনো জাহান্নামি ব্যক্তিকে দেখে আনন্দবোধ করে, সে যেন এই লোকটাকে দেখে নেয়।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৯৫)

শহীদের মর্যাদা লাভ

কিছু রোগব্যাধি আছে, যারা সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে, তারা শহীদের মর্যাদা লাভ করতে পারে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তি ছাড়াও আরো সাতজন ‘শহীদ’ আছেন। তারা হলেন, মহামারিতে মৃত (মুমিন) ব্যক্তি, পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি, ‘জাতুল জাম্ব’ (নানা ধরনের পেটের রোগ, যেমন—গর্ভে সন্তান মরে যাওয়া ইত্যাদি) নামক কঠিন রোগে মৃত ব্যক্তি, (কলেরা, ডায়রিয়া বা অনুরূপ) পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি, আগুনে পুড়ে মৃত ব্যক্তি, দেয়াল ধসে চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মারা যাওয়া নারী।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩১১১)

সুতরাং রোগব্যাধিতে হতাশ ও পেরেশান না হয়ে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য।