২০১৯ সালে দেশ ছিল ডেঙ্গু ভাইরাসের কবলে। আক্রান্ত ছিল পাঁচ লাখের বেশি মানুষ, মারা গেছে প্রায় চার হাজার। তবে ওই বছর শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। এরপর গত বছরের মার্চ থেকে শুরু হয় করোনাভাইরাসের মহামারি। সব হাসপাতালেই চিকিৎসাব্যবস্থা হয়ে পড়ে করোনামুখী। মাঝে কয়েক মাস অনেক হাসপাতালে ছিল না অন্য কোনো রোগী। সারা দেশে গত বছরজুড়ে ডেঙ্গু রোগী ছিল এক হাজার ৪০৫ জন, মারা যায় সাতজন। তবে করোনার তীব্রতার মধ্যেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভেতরে ভেতরে চলে ডেঙ্গুর কিট কেনার হিড়িক। এ কেনাকটায় যেমন কোথাও কোথাও দু-তিন গুণ বেশি দাম দেওয়া হয় আবার কোথাও কিট বুঝে না পেয়েই বিল পরিশোধ করার ঘটনাও ঘটে।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে আরো বড় হয়ে ওঠা ঘটনা হলো কোনো কোনো হাসপাতাল থেকে রীতিমতো হাজার হাজার ডেঙ্গু কিট গায়েব হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকদল ওই হাসপাতালগুলোর কাগজ আর মজুদ মিলিয়ে বিপুলসংখ্যক কিটের দেখা পায়নি। তবে এবারও ডেঙ্গুর মৌসুম (বর্ষাকাল) সামনে রেখে হাসপাতালগুলোতে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতিও রাখা হচ্ছে, যার অংশ হিসেবে শুরু হয়েছে ডেঙ্গু কিট কেনাকাটার প্রক্রিয়া।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, কেনাকাটার বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না। তবে করোনার মধ্যে গত বছরও সব হাসপাতালে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনাও চালু রাখার জন্য বলেছি, এবারও সেটাই বলছি। কারণ অনেকের করোনার মতো উপসর্গ হলেও দেখা যাচ্ছে করোনা নেগেটিভ আসছে, ফলে তার ডেঙ্গুও হতে পারে। সে জন্যই আমরা যাদের করোনা নেগেটিভ তাদের উপসর্গ থাকলে ডেঙ্গু টেস্টও করতে বলি। সে জন্যই হাসপাতালগুলোতে ব্যবস্থা রাখা হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শক দলের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক কোটি ৭২ লাখ রি-এজেন্ট কেনা হয়। যার মধ্যে কয়েকটি লটে ডেঙ্গু টেস্ট কিট (এনএসআই) ছিল। গত বছর ১৩ এপ্রিলের একটি লটে এক হাজার ৪৫২টি কিট কেনা হয়। চলতি অর্থবছরের ২৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া হয় আরো ১০ হাজার কিট। ১৭ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শকদল ওই হাসপাতালের নথিপত্রের হিসাবে দেখতে পায়, সব মিলিয়ে ১১ হাজার ৪৫২টি কিটের মধ্যে খরচ হয়েছে মাত্র ৯টি। ফলে স্টোরে থাকার কথা ১১ হাজার ৪৪৩টি। কিন্তু পাওয়া যায় পাঁচ হাজার ৪০০টি। বাকি ছয় হাজার ৪৩টি কিট কোথায় গেল? বাজারদর অনুসারে গায়েব হয়ে যাওয়া ওই কিটের দাম প্রায় ২২ লাখ টাকা। কিটগুলো কেনা হয় প্রতিটি ৩৬৩ টাকা দরে লেক্সিকন মার্চেন্ডাইজের কাছ থেকে। তখন এই কিটের বাজারদর ১২৮ টাকা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে একই হাসপাতালে কেথ্রিইডিটিএ টিউব কেনা হয় দুই লটে ১২১ বক্স। সেখান থেকে হাসপাতালের নথিতে ব্যবহার করা হয়েছে দেখা যায় মাত্র তিন বক্স। ফলে স্টোরে ১১৮ বক্স মজুদ থাকার কথা; কিন্তু মজুদ পাওয়া যায় ৮৩ বক্স। বাকি ৩৫ বক্সের খোঁজ নেই। প্রতি বক্সে এক হাজার করে ৩৫ হাজার টিউব ছিল। আর প্রতি বক্স কেনা হয়েছিল ২৫ হাজার টাকা করে। আবার দামের ক্ষেত্রে এক লটের চেয়ে অন্য লটের দামে ছিল পার্থক্য।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও তিন হাজার ২৫৪টি ডেঙ্গু কিটের হদিস পায়নি মন্ত্রণালয়ের দল।
শুধু মুগদা হাসপাতালেই এমন কাণ্ড নয়, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক লট ডেঙ্গু কিট কেনা হয়েছে প্রতি পিস ১৭৫ টাকা করে; কিন্তু অন্য লট কেনা হয় ৩৪৮ টাকা দরে। আবার আরেক লট কেনা হয়েছে ২৪৮ টাকা দরে। কুর্মিটোলা হাসপাতালে কোনো লট কেনা হয়েছে ২৮৫ টাকায় আবার কোনো লট কেনা হয়েছে ৩৭৯ টাকা।
ঢাকা মেডিক্যালেও একই কম্পানির কাছ থেকে একবার এক লটে কেনা হয়েছে ১২৮ টাকা প্রতি পিস দরে, আবার ওই কম্পানির কাছ থেকেই একই কিট কেনা হয় ২৫৯ টাকা দামে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ডেঙ্গুবিষয়ক কর্মসূচির উপব্যবস্থাপক ডা. আফসানা আলমগীর খান কালের কণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালগুলোকে আমরা এবারও ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতির আওতায় প্রয়োজনমতো কিট কিনে নিতে বা আমাদের কাছে চাহিদা পাঠাতে বলেছি। ক্রয়প্রক্রিয়ার আওতায় হাসপাতালগুলো নিজেরাও স্থানীয়ভাবে কিট কিনতে পারে, আবার আমরাও অপারেশনর প্ল্যানের মাধ্যমে কিট কিনে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠাই। গত বছরও এই প্রক্রিয়ায় হাসপাতালগুলো কিট সংগ্রহ করে। কেন্দ্রীয়ভাবে গত বছর আমরা সারা দেশের এক লাখ আট হাজার দুটি কিট সরবরাহ করেছি।
কিটের হদিস না মেলা প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মনিটরি করছি। এবারও চিঠি দিয়েছি সব হাসপাতালে। কার কাছে কত কিট আছে না আছে, তা জানতে চেয়েছি। তবে আমরা যে কিট দিয়েছি সেগুলোর মেয়াদ এবারও শেষ হয়নি। দেওয়ার সময়ই আমরা মেয়াদ দেখে কিনেছি। কোনোটির এক বছর আবার কোনোটির তিন বছর মেয়াদ আছে।’