দেশে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় সরকারের জারি করা কঠোর বিধি-নিষেধ বা লকডাউনের সময় শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক ও আচরণগত সমস্যা আগের তুলনায় বেশি দেখা গেছে। এই কারণে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও ঘটে। এ ধরনের সমস্যায় ভুগেছেন মা-বাবারাও। গত বছর মে মাসে করা এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, গড়ে ২১.৫ শতাংশ শিশু ও কিশোর এই ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছে, যা করোনা প্রাদুর্ভাবের আগের সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ বেশি। এখন লকডাউন না থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগ ৩৯.৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এ অবস্থায় আজ ১০ অক্টোবর পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’।
‘কভিড-১৯ মহামারির সময় শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন এবং তাদের পিতা-মাতার হতাশার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক’ শীর্ষক এই গবেষণার ফল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক একটি জার্নালে প্রকাশের প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে গবেষকদের সূত্রে জানা গেছে।
অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে ৫১২ জন মা-বাবার ওপর সমীক্ষা চালানো হয়, যাঁরা তাঁদের সন্তানদের পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য জানান গবেষকদলকে। তাঁদের মধ্যে ২৯৩ জন মা (৫৭.২%) এবং ২১৯ জন বাবা (৪২.৮%)।
গবেষকদলে ছিলেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ, একই প্রতিষ্ঠানের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাঈদ।
কেবল বাংলাদেশে নয়, অন্যান্য দেশেও লকডাউনের প্রভাবের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে তাঁদের গবেষণাপত্রে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৪ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে গড়ে ২১.৫ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের মানসিক ও আচরণগত সমস্যায় ভুগেছে। মানসিক সমস্যায় ভোগে ১০.২ শতাংশ এবং আচরণগত সমস্যা হয়েছে ২৬.৮ শতাংশের। অতিচাঞ্চল্য (হাইপার অ্যাক্টিভিটি) ছিল ১৯.৯ শতাংশের মধ্যে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে ৩৬.৫ শতাংশের। অন্যদিকে ১৬.২ শতাংশ মা-বাবার মধ্যে মাঝারি বিষণ্নতা, ৫.৫ শতাংশের মাঝারি পর্যায়ের গুরুতর বিষণ্নতা এবং ২.৯ শতাংশের মধ্যে তীব্র বিষণ্নতা ছিল। বাবাদের তুলনায় মায়েরা বেশি সমস্যাগ্রস্ত ছিলেন।
করোনার আগের সময়ে ৪ থেকে ১০ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে মানসিক ও আচরণগত সমস্যা ছিল ১৫ শতাংশের এবং ১১ থেকে ১৭ বয়সীদের একই সমস্যা ছিল ১৮ শতাংশের।
গবেষকদল চীনের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি তুলে ধরে জানায়, সেখানে সব বয়সের শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মানসিক সমস্যা ছিল আটকে থাকা, অসাবধানতা এবং বিরক্তি। ইতালি ও স্পেনের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়, ওই দেশগুলোকে শিশুদের মধ্যে ঘন ঘন লক্ষণগুলো ছিল মনোনিবেশে অসুবিধা (৭৬.৬%), একঘেয়েমি (৫২%), বিরক্তি (৩৯%), অস্থিরতা (৩৮.৮%)।
গবেষকদলের অন্যতম সদস্য জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশের বিষয়গুলোর কভিডের আগের ইতিহাস বিবেচনায় নিয়েছি। তথ্য সংগ্রহের সময় পরিবারে কভিড রোগী থাকার কারণে অনেক পরিবার লকডাউনের আওতায় ছিল। এই জরিপের ৩৪.২ শতাংশ উত্তরদাতা লকডাউনের আওতায় বাড়িতে ছিলেন। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সমস্যাগুলো বেশি পাওয়া গেছে। অতি আবেগের লক্ষণ, আচরণগত সমস্যা, অস্থিরতা-অসাবধানতা, সামাজিক নয় এমন আচরণ বিবেচনায় নেওয়া হয়।
গবেষণায় পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, যাঁরা এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ২৩ শতাংশ উত্তরদাতার পরিবারের কেউ না কেউ করোনায় মারা গেছেন। ৮ শতাংশের কেউ না কেউ আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ৩৪.২ শতাংশ পরিবার লকডাউনেরও আওতায় ছিল।