বাজারে একটি বৈদ্যুতিক সুইচের দাম সর্বোচ্চ ৩০ টাকা, একটি ১২ ওয়াটের এলইডি বাল্বের দাম সর্বোচ্চ ২৮০ টাকা, দেড় হর্সের একটি কারেন্ট মোটরের দাম সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ হাজার টাকা। অথচ বিল-ভাউচারে বৈদ্যুতিক সুইচের দাম ৪৫০ টাকা, বাল্বের দাম ৮৫০ টাকা আর একটি কারেন্ট মোটরের দাম ২৫ হাজার টাকা ক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার খোর্দ্দ বিছনদই মাহাতাব উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মেরামতের কাজে পণ্যসামগ্রী ক্রয়মূল্যের এমন ‘আজব’ বিল-ভাউচার দেখানো হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় ভবনটির মেরামত কাজ এখন শেষ হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বিদ্যালয় ভবনটি নবনির্মিত রঙিন টিনশেটের হলেও ডিসটেম্পার পেইন্ট চার ড্রাম রঙের নামে ৩২ হাজার টাকা ব্যয়ের বিল-ভাউচার দেখানো হয়। এভাবে দুই লাখ টাকার বিল-ভাউচার উপজেলা হিসাবরক্ষক অফিস থেকে পাশও করানো হয়েছে।
তবে উপজেলার সদ্য জাতীয়করণকৃত কেতকীবাড়ী পাইকারটারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র।
ওই বিদ্যালয়ের নতুন শ্রেণিকক্ষ তৈরির জন্য দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে বলা হয়েছে, লোহার এঙ্গেল ব্যবহারের পাশাপাশি মানসম্পূর্ণ টিন দিয়ে শ্রেণিকক্ষ তৈরি করতে হবে। কিন্তু লোহার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহারের পাশাপাশি প্রচলিত .০৪৬০ মি. মি. টিনের পরিবর্তে অতি নিম্নমানের .০১৪০ মি.মি ঢেউটিন ব্যবহার করা হয়েছে। দুই মাসেই সেই টিন ফুটো হয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে শ্রেণিকক্ষগুলোতে। ফলে পানিতে ভিজেই ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা।
পিইডিপি-৪ ও রাজস্ব বাজেটের আওতায় দুটি প্রকল্পের মেরামতে এ অনিয়মের চিত্র শুধু ওই দুইটি বিদ্যালয়েই নয়। হাতীবান্ধা উপজেলার ৩৭টি বিদ্যালয় দুই প্রকল্পে দেড় লাখ ও দুই লাখ টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছে। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে নামমাত্র কাজ করে বিল-ভাউচারের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করেছে এমন অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পিইডিপি-৪ প্রকল্পের আওতায় হাতীবান্ধায় ১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুই লাখ টাকা করে ও রাজস্ব খাত প্রকল্পের আওতায় ২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেড় লাখ টাকা করে মোট ৬৪ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে।
গত অর্থ বছরেই জুন ক্লেজিং’র (ব্যাংকিং ভাষায় বলা হয়) আগেই প্রতিটি বিদ্যালয় কাজ শেষ করে বিল-ভাউচার জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও হাতীবান্ধা উপজেলায় তা মানা হয়নি। জুন ক্লোজিং’র সময় বিল ভাউচার জমা দিয়ে টাকা ব্যয়ের বৈধতা পেলেও ওই টাকার একটি অংশ এখনো উত্তোলন করা হয়নি। এ ছাড়া খোর্দ্দ বিছনদই মাহাতাব উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের দ্বন্দ্বের কারণে বরাদ্দকৃত দুই লাখ টাকা এখনো উত্তোলন করা হয়নি।
নাম না প্রকাশের শর্তে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন সহকারী শিক্ষক জানান, বরাদ্দকৃত টাকা তুলতে উপজেলা পর্যায়ে কিছু টাকা দিতে হচ্ছে বলে প্রধান শিক্ষকরা বলছেন। বাকি টাকা দিয়ে নামমাত্র কাজ করে স্কুল সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক ভাগাভাগি করেছেন। এ ছাড়া বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রতি বিদ্যালয়ে ৪০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র মেরামত, রুটিন মেইনটেন্যান্স, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরণ ও উপকরণ ক্রয় বাবদও রয়েছে বরাদ্দ। পুরো বিষয় তদন্ত করা হলে আরও অনিয়ম বের হবে।
হাতীবান্ধা উপজেলার কেতকীবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ গড্ডিমারী পল্লী শ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় প্রকল্পের সঙ্গে বাস্তবায়ন হওয়া কাজের কোনো মিল নেই। দক্ষিণ গড্ডিমারী পল্লী শ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বজলার রহমান শতভাগ কাজ হয়েছে বলে দাবি করলেও তার বিদ্যালয়ে কী কী কাজ হয়েছে এবং কাজের ভাউচার দেখাতে পারেননি।
খোর্দ্দ বিছনদই মাহাতাব উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপস চন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘এক জনের মাধ্যমে বিল-ভাউচারটি করে নিয়েছি। আমি আগেও সেভাবে দেখি নাই। এখন দেখে নিজেই বিব্রত হয়ে পড়েছি।’
আর কেতকীবাড়ী পাইকারটারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক দোলেয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করতে আমি ঋণি হয়ে পরেছি। তা ছাড়া নতুন ভবন হবে তাই সাময়িক শ্রেণিকক্ষ তৈরি করেছি।’
হাতীবান্ধা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সোলেমান মিয়া বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকদের বলা হয়েছে কাজ শেষ করে পরিচালনা কমিটির রেজুলেশন জমা দিয়ে বাকি টাকা উত্তোলন করতে। কিন্তু তারা রেজুলেশন নিয়ে না আসলে আমরা কীভাবে টাকা দিবো।’
হাতীবান্ধার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামিউল আমিন বলেন, ‘আমিও কয়েক বিদ্যালয়ে কাজে অনিয়ম হয়েছে এমন অভিযোগ পেয়েছি। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’