উম্মে সুলাইম (রা.)
উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান (রা.) ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবি আনাস বিন মালিক (রা.) এর মা। তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তিনি তাঁর জীবন, সন্তান ও পরিবার সব কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সেবায় নিয়োজিত করেন। উম্মে সুলাইম (রা.) এর মূল নাম কী ছিল, তা নিয়ে তিনটি মত পাওয়া যায়। তা হলো, রুমাইলা, গুমাইসা ও রুমাইসা। তাঁর প্রথম স্বামী মালিক বিন নজর উম্মে সুলাইম ইসলাম গ্রহণে অসন্তুষ্ট হয়ে শামে চলে যান। আর কখনো ফিরে আসেননি। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। প্রথম স্বামীর ঔরসে আনাস (রা.)-এর জন্ম হয়। (আসাদুল গাবাহ : ৩৪৫/৭)
স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকেই উম্মে সুলাইম (রা.)-কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আবু তালহা আনসারি তাঁদের একজন। তবে তিনি তখনো কাফের। অমুসলিম হওয়ায় উম্মে সুলাইম (রা.) তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও মানুষ হিসেবে তাঁকে পছন্দ হয়। তিনি তাঁকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তুমি ইসলাম গ্রহণ করলে সেটাই হবে আমার মোহরানা। তা ছাড়া আর কিছুই আমি চাই না।’ (তাবাকাতে ইবনে সাদ : ৪২৬/৮)
উম্মে সুলাইম (রা.)-এর আহ্বান আবু তালহার পছন্দ হয় এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু তালহার ইসলাম গ্রহণ ও তাঁদের বিয়ে আরবে আলোচনার সৃষ্টি করে। বলা হয়, ইসলামের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান মোহর।
উম্মে সুলাইম (রা.) ছিলেন একজন আদর্শ মা। শিশুকালে সন্তানদের তিনি ইসলাম ও ইসলামী জীবনে অনুপ্রাণিত করেন। সন্তানদের ইসলামের জন্য উত্সর্গ করেন তিনি। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যখন মদিনায় আসেন তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। মা আমার হাত ধরে রাসুল (সা.)-এর কাছে নিয়ে যান। মা রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আনসারের সব নারী ও পুরুষ আপনাকে কোনো না কোনো কিছু হাদিয়া দিয়েছে। আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছু নেই। আমার কাছে কেবল আমার ছেলে আছে। আপনি ওকে হাদিয়া হিসেবে গ্রহণ করুন, সে আপনার প্রয়োজনের সময় খেদমত করবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৮০)
সন্তানের সুশিক্ষা ও নিবিড় পরিচর্যার জন্য এর চেয়ে উত্তম আর কী-ই বা হতে পারে। রাসুল (সা.)-এর হাতে সন্তানকে সঁপে দিয়ে তিনি শুধু বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়নি; বরং সৌভাগ্যের অংশীদার হয়েছেন।
বিপদের সময় ধৈর্য ধারণেও উম্মে সুলাইম (রা.) সবার জন্য ছিলেন অনুকরণীয়। আল্লাহর যেকোনো ফয়সালা তিনি মেনে নিতেন দ্বিধাহীন চিত্তে। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আবু তালহা (রা.)-এর ছেলে মারা গেলে বাড়ির লোকদের ছেলের মা উম্মে সুলাইম বলেন, তারা যেন ছেলে সম্পর্কে আবু তালহাকে কিছু না বলে। তাকে যা বলার সে-ই বলবে। আবু তালহা বাড়ি এলে উম্মে সুলাইম তাকে রাতের খাবার দিলেন। তিনি খাবার খেলেন। অতঃপর উম্মে সুলাইম স্বামীর জন্য সাজসজ্জা করলেন। আবু তালহা সে রাতে তাঁর সঙ্গে সহবাস করলেন। উম্মে সুলাইম দেখলেন, আবু তালহা তৃপ্ত হয়েছে ও তার প্রয়োজনও পূরণ হয়েছে। তখন তিনি বললেন, আবু তালহা, দেখুন! কেউ কোনো পরিবারকে কোনো কিছু ঋণ দিলে, এরপর তা ফেরত চাইলে ওই পরিবারের তা ফেরত না দেওয়ার কোনো অধিকার আছে? আবু তালহা বলল, না। উম্মে সুলাইম বললেন, তাহলে আল্লাহর কাছে আপনার ছেলের জন্য সওয়াব প্রত্যাশা করুন। এই কথা শুনে আবু তালহা রেগে গেলেন আর বললেন, তুমি আগে কিছু বললে না, অথচ আমি তোমার সঙ্গে এত কিছু করে ফেললাম। এখন তুমি আমার ছেলের খবর দিচ্ছ। তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে সব কথা বললেন। সব কিছু শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমাদের উভয়ের রাতে আল্লাহ বরকত দিন।’
সাবেত (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি উহুদের যুদ্ধে আয়েশা (রা.) ও উম্মে সুলাইম (রা.)-কে পিঠে করে পানির পাত্র নিয়ে যেতে দেখেছি। তারা মানুষকে পানি পান করিয়ে পাত্র খালি করত। আবার ভরে এনে পানি পান করিয়ে পাত্র খালি করত।’ সাবিত (রা.) আরো বলেন, ‘হুনাইনের যুদ্ধের দিন আবু তালহা (রা.) উম্মে সুলাইমের দিকে ইঙ্গিত করে রাসুল (সা.)-কে হাসাচ্ছিলেন। আবু তালহা বলছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি উম্মে সুলাইমকে আজ দেখেছন? সে আজ একটা খঞ্জর নিয়ে এসেছে। তখন রাসুল (সা.) উম্মে সুলাইমকে প্রশ্ন করলেন, ‘উম্মে সুলাইম, খঞ্জর দিয়ে কী করবে?’ মুশরিকদের কেউ আমার কাছে এলে এটা দিয়ে তাকে আঘাত করব। তাই এটা নিয়ে এলাম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৮০৯)
উম্মে সুলাইম (রা.) ছিলেন বহুগুণে সমৃদ্ধ একজন নারী সাহাবি। রাসুল (সা.) তাঁকে সমীহ করতেন। দুনিয়াতেই তিনি জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি জান্নাতে প্রবেশ করে আমার সামনে কারো জুতার আওয়াজ শুনতে পাই। দেখি, আনাস বিন মালেকের মা গুমাইসা আমার পাশে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৬৭৯)