ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হাতিরঝিল এলাকায় গাড়ি ওঠা-নামার জন্য র্যাম্প রাখার প্রস্তাবে দ্বিমত পোষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে তিনি এলাইনমেন্টটি পাওয়ার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে আবার উত্থাপনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এখন সে অনুযায়ীই প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক এএইচএম আকতার।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৭ মে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ঢাকা শহরের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনাসভা হয়। সেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হালনাগাদ অগ্রগতি ও ভিডিওচিত্র উপস্থাপন করা হলে এ নিয়ে দুটি সিদ্ধান্ত আসে। ১. হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে কোনো র্যাম্প নেওয়া যাবে না এবং আগের এলাইনমেন্ট অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে হবে। ২. হাতিরঝিল এবং হানিফ ফ্লাইওভার অংশসহ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পূর্ণাঙ্গ এলাইনমেন্ট আবার দেখাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার পর দফায় দফায় বৈঠক করে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রকল্প কার্যালয়। বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয় প্রকল্পের বিনিয়োগকারী ইতাল থাই লিমিটেডকেও। কিন্তু এতে আপত্তি জানায় বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে, হাতিরঝিল অংশে গাড়ি ওঠা-নামার সুবিধা না থাকলে প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে না। অর্থাৎ টোল আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ মোট ট্রাফিকের ২০ শতাংশ এ লিঙ্কের মাধ্যমেই সুবিধা দেওয়ার কথা।
এ নিয়ে টানা দুবছর ধরে চলে চিঠি চালাচালি। এ বিবেচনায় হাতিরঝিলের পানিতে পিয়ার যথাসম্ভব কমিয়ে হলেও র্যাম্প স্থাপন করার ব্যাপারে অবস্থান নেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। তাই বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরে সম্প্রতি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রস্তাবে অনুমতি না দিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, উড়ালসড়কের সোনারগাঁও-বুয়েট লিংকের সংশোধিত এলাইনমেন্টটি পাওয়ার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে আগে দেখাতে হবে। এর পর নেওয়া হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক এএইচএম আকতার আমাদের সময়কে বলেন, ‘সংশোধিত এলাইনমেন্টের প্রস্তাবটি পাওয়ার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এসেছে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুত করছি।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এ উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সোনারগাঁও-বুয়েট লিংকটি হাতিরঝিলের দক্ষিণ প্রান্তে বিয়াম ভবনের পাশ দিয়ে যাবে। এর পর পান্থকুঞ্জের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে কাঁটাবন হয়ে পলাশী পর্যন্ত যাওয়ার কথা রয়েছে। এ লিংকটি প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি বিনিয়োগকারীদের। কেননা এখানে তিনটি ওঠা এবং চারটি নামার র্যাম্প রয়েছে। সেখানে গাড়ি ওঠা-নামার সুবিধা না থাকলে অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে না বলেও মনে করছেন তারা। এ বিবেচনায় হাতিরঝিলের পানিতে পিয়ার যথাসম্ভব কমিয়ে হলেও র্যাম্প স্থাপনের ব্যাপারে পরামর্শ আসে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংশোধিত চুক্তি অনুযায়ী গত ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দ্বিতীয় অংশের জমি বিনিয়োগকারীকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। আর তৃতীয় অংশের জমি বুঝিয়ে দিতে হবে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। আর এতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জরিমানা দাবির সুযোগ রয়েছে। তাই প্রকল্পের হাতিরঝিল অংশের এলাইনমেন্ট দ্রুত সংশোধন হওয়া জরুরি বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়।
এর আগে প্রকল্পের এলাইনমেন্ট জটিলতা নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পটির ব্যয় বাড়লে আবার ব্যাংকের কাছে যেতে হবে। তাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন আরও বিলম্বিত হতে পারে। তাই ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রেখেই ডিজাইন করতে হবে। যেহেতু উড়ালসড়ক প্রকল্পটি বেসরকারি বিনিয়োগে হচ্ছে, তাই বারবার ব্যয় ও নকশা পরিবর্তন সম্ভব হবে না। তাই বারবার ব্যয় ও নকশা পরিবর্তন সম্ভব হবে না।’ এর সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ বিষয়টিও তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিনিয়োগকারী তথা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইতাল থাইয়ের সঙ্গে চুক্তিসই করে সেতু কর্তৃপক্ষ। ২৫ বছরের কনসেশন পিরিয়ডের মধ্যে সাড়ে তিন বছর ধরা হয় নির্মাণকাল হিসাবে। প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর। এর প্রথম ধাপ ২০১৯, দ্বিতীয় ধাপ ২০২০ এবং তৃতীয় ধাপ ২০২২ সালে শেষ করার কথা রয়েছে। কিন্তু নকশা জটিলতার পাশাপাশি অর্থাভাবে দীর্ঘদিন ধরে পিছিয়ে ছিল ঢাকা উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ। টাকা জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে আরও একাধিক প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে বিনিয়োগকারী ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। সেখানে ইকুইটি (সম মূলধন) ধরা হয়েছে ১২৭ মিলিয়ন ডলার। এর ৫১ ভাগ দেবে ইতাল থাই কোম্পানি। আর বাকি ৪৯ ভাগ দেবে স্যানডং এবং সিনোহাইড্রো।
চায়না এক্সিম ব্যাংক এবং আইসিবিসি (ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল অব চায়না ব্যাংক) থেকে তারা ঋণ নেবে ৮৬৭ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চায়না এক্সিম ব্যাংক থেকে ৪৬১ মিলিয়ন ডলার (৩ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা) এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার (৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা)। সর্বমোট ৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকার ঋণচুক্তি করেছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।