বাজারদরের চেয়ে অর্ধেক মূল্যে দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ কিনছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৯ মডেলের উড়োজাহাজ দুটি কেনার সব প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এগুলো বিমানবহরে যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া আরও তিনটি নতুন উড়োজাহাজ কেনা হচ্ছে কানাডা থেকে। এসব উড়োজাহাজ দিয়ে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে বেশ কয়েকটি নতুন ফ্লাইট চালু হবে। তার আগে আজ চালু হচ্ছে ঢাকা-মদিনা ফ্লাইট।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক আমাদের সময়কে বলেন, বিমানে নতুন নতুন রুট চালু হবে। কেনা হচ্ছে নতুন উড়োজাহাজও। সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি গন্তব্য ও উড়োজাহাজ বৃদ্ধিতেও নজর দেওয়া হয়েছে।
বিমান কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ঢাকা-মদিনা রুটে ফ্লাইট চালু হচ্ছে আজ ২৮ অক্টোবর। এর পর ৩১ অক্টোবর থেকে চট্টগ্রাম-মদিনা রুটে যাত্রীসেবা দেবে এ সংস্থা। ২৭১ আসনের বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার দিয়ে এসব রুটে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। ঢাকা-মদিনা ফ্লাইট প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে তিন দিন (সোম, বুধ ও শনিবার) পরিচালিত হবে।
চট্টগ্রাম-মদিনা-চট্টগ্রাম ফ্লাইটটি সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার চলাচল করবে। দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে মদিনার প্রিন্স মোহাম্মদ বিন আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৫টায় পৌঁছাবে। সেখান থেকে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে ফ্লাইটটি ছেড়ে পরের দিন ঢাকায় ভোর ৪টা ২৫ মিনিটে অবতরণ করবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং থেকে নতুন দুটি উড়োজাহাজ ডিসেম্বরের মধ্যেই বিমানবহরে যুক্ত হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ৩শ যাত্রী পরিবহনে সক্ষম এ উড়োজাহাজ। সাধারণত একেকটি উড়োজাহাজের দাম প্রায় ৩শ মিলিয়ন ডলার। এর অর্ধেক দামে কিনতে পারার সুযোগ তৈরি হয়েছে মূলত চীনের কারণে। দেশটির হেইনান এয়ারলাইন্স ড্রিমলাইনার দুটি কেনার অর্ডার দিয়েছিল। এখন তারা আর কিনতে আগ্রহী নয়। মূলত চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণেই এ অবস্থার তৈরি হয়েছে। তাই দরকষাকষি করে অর্ধেক মূল্যে উড়োজাহাজ দুটি কেনার বিষয় চূড়ান্ত করে বিমান কর্তৃপক্ষ। তবে বোয়িং কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করে, ওই দর যেন জানাজানি না হয়।
সাধারণত বোয়িং থেকে কেনা উড়োজাহাজ পেতে কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়। কারণ চুক্তির পরই তারা সুনির্দিষ্ট এয়ারলাইন্সের জন্য সুনির্দিষ্ট মডেলের উড়োজাহাজ তৈরির কাজ শুরু করে। তাই অর্থ থাকলে, পরিশোধ করা হলেও কেউ নতুন একটি উড়োজাহাজ পাবে না। ২০০৮ সালে করা এ রকম চুক্তি অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ১০টি উড়োজাহাজ কেনে বিমান। এবার সাশ্রয়ী মূল্যে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কিনতে পারার আরেকটি কারণ বোয়িংয়ের ‘ম্যাক্স মডেল’ দুর্ঘটনা। কয়েক মাসের ব্যবধানে ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়ায় দুটি বিমান দুর্ঘটনার পর গ্রাউন্ডিং শুরু হয় বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের। পর্যায়ক্রমে বোয়িংয়ের অন্য মডেল থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে এয়ারলাইন্সগুলো।
বোয়িংয়ের দুটি নতুন উড়োজাহাজ কেনা ছাড়াও কানাডা থেকে তিনটি উড়োজাহাজ কিনছে বিমান কর্তৃপক্ষ। এগুলো বিমানবহরে যুক্ত হবে আগামী বছরের মার্চ, মে ও জুনের মধ্যে। ড্যাশ৮-কিউ ৪০০এনজি মডেলের এয়ারক্রাফটগুলো কেনা হবে কানাডার বোমবারডিয়ার ইনক নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
বিমানবহরে নতুন এয়ারক্রাফট যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে রুটের সংখ্যা। আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকা-ম্যানচেস্টার সরাসরি ফ্লাইট চালু হচ্ছে। ঢাকা-ম্যানচেস্টার সরাসরি ফ্লাইট চালু করার সব প্রস্তুতিই এর মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে ম্যানচেস্টারে ফ্লাইট চালু করার অনুমোদন দিয়েছেন। এ ছাড়া চালু হচ্ছে ঢাকা-সিডনি ও ঢাকা টরেন্টো সরাসরি ফ্লাইট। তা ছাড়া ইতোমধ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) মান ক্যাটাগরি-২ থেকে ১-এ উন্নীতকরণের কাজ চলছে। যে কোনো মুহূর্তে ঘোষণা আসতে পারে। এর ফলে চালু হবে বহুল প্রত্যাশিত ঢাকা-নিউইয়র্ক ফ্লাইট। তবে ঘোষণা দিয়েও চালু হয়নি বিমানের ঢাকা-গুয়াংজু ফ্লাইট।
এসব বিষয়ে বিমান সচিব মহিবুল হক বলেন, এয়ারক্রাফটের সঙ্গে সঙ্গে রুটও বাড়বে। ম্যানচেস্টার, সিডনি ও টরেন্টোর ফ্লাইট চালুর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যেও ফ্লাইট বাড়ানো হবে।
বহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ও ঐকান্তিক আগ্রহে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহর এখন অনেক আধুনিক। আমাদের বিমানবহরে রয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সব উড়োজাহাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারী কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে আনা ব্র্যান্ড নিউ ১০টি উড়োজাহাজ এখন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিমানে যুক্ত হওয়া সর্বশেষ বোয়িং ড্রিমলাইনার ৭৮৭ (রাজহংস) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই অনুষ্ঠানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সংক্রান্ত ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, বোয়িং শিগগিরই তাদের র্আর দুটি উড়োজাহাজ বিক্রি করবে, কেউ এখনো অর্ডার দেয়নি, সুযোগটা তারা নেবেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সবুজসংকেত পেয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়ে ওঠে কীভাবে এ দুটি উড়োজাহাজ কেনা যায়।
বর্তমানে একটি ড্রিমলাইনারের বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বিমান চাইছে দরকষাকষি করে বাজারমূল্য কমাতে। বোয়িংয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। ওই কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েক দফার বৈঠকে দামের ব্যাপারে একটি বোঝাপড়া চূড়ান্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিমান সচিব মহিবুল হক জানান, তারা যে দুটি ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৯ কিনতে চাচ্ছেন তা এরই মধ্যে বিক্রির জন্য প্রস্তুত। চীনের এয়ারলাইন্সটি তা না কেনায় বিমান বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে কিনতে চাইছে। এ জন্য দরকষাকষিও হচ্ছে। বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিমান উড়োজাহাজ দুটি কিনতে পারবে বলে আশা করছেন তিনি।
সচিব জানান, এ উড়োজাহাজ কেনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চুক্তির বিস্তারিত সব তথ্য প্রকাশ করা হবে, যাতে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকে।
উড়োজাহাজ দুটি ডিসেম্বর মাসের দিকে দেশে আসবে। এ দুটি উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হলে বিমানের নিজস্ব উড়োজাহাজের সংখ্যা দাঁড়াবে ১২টিতে। ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৯ মডেলের একটি উড়োজাহাজ ৩শ যাত্রী পরিবহন করতে পারে। টানা ১৪ হাজার কিলোমিটার উড়তে সক্ষম এ উড়োজাহাজের দৈর্ঘ্য ২০৬ ফুট।
এ দুটি উড়োজাহাজ ছাড়াও বিমান কানাডা থেকে আরও তিনটি ড্যাশ৮ উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে। কয়েক মাসের মধ্যে এ উড়োজাহাজগুলো বিমানের বহরে যুক্ত হচ্ছে। জিটুজি পদ্ধতিতে এ উড়োজাহাজ কিনতে চুক্তি হয়েছে।
বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স গ্রাউন্ডিংয়ের ফলে এক বছরে শতকোটি ডলার লোকসান গুনেছে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স সংস্থা। কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটি মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনার পর বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স গ্রাউন্ডিংয়ের ফলে এ লোকসানে হতাশ এয়ারলাইন কর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ম্যাক্স ব্যবহারকারী সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স বলছে, গ্রাউন্ডিংয়ের ফলে গত প্রান্তিকে তাদের লোকসান হয়েছে ২১ কোটি ডলার। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে আয় হয়েছে ৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০২০ সালে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আশাবাদ এয়ারলাইন্সটির।
গত বৃহস্পতিবার সিএনবিসির স্কোয়াক অন দ্য স্ট্রিট অনুষ্ঠানে সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের সিইও গ্যারি কেলি বলেন, আমরা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট নই। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ ম্যাক্সের হাতে সঁপে দিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলো এখন গ্রাউন্ডেড রয়েছে। আমাদের ক্ষতিপূরণের জন্য বোয়িংয়ের সঙ্গে বসতে চাচ্ছি।
ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়ায় দুটি বিমান দুর্ঘটনার পর গ্রাউন্ডিং শুরু হওয়ার সময় সাউথওয়েস্টের হাতে ৩৪টি ম্যাক্স উড়োজাহাজ ছিল; যা যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো এয়ারলাইন্সের চেয়ে বেশি। গ্রাউন্ডিংয়ের সিদ্ধান্তে এয়ারলাইন্সটির টিকিট বিক্রি কমে যায় এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে আগামী বছরে ৭৫টি ম্যাক্স উড়োজাহাজ সংগ্রহ করার কথা রয়েছে সাউথওয়েস্টের, কিন্তু সময়সীমা এখন স্পষ্ট নয়।
কেলি জানান, সাউথওয়েস্ট এতদিন বোয়িংয়ের সিঙ্গেল আইলবিশিষ্ট উড়োজাহাজ ব্যবহার করে এলেও বর্তমানে অন্যান্য ধরনের উড়োজাহাজও ব্যবহারের কথা ভাবছে। তবে এ রকম একটি জটিল সিদ্ধান্ত কার্যকরে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
৭৩৭ ম্যাক্সের মতো বোয়িংয়ের সর্বাধিক বিক্রীত উড়োজাহাজটির সফটওয়্যার ত্রুটি সারাইয়ের বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের অবহিত করা হয়েছে। উড়োজাহাজটির ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেমের ত্রুটির কারণে ২০১৮ সালে অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ায় লায়ন এয়ারের একটি ম্যাক্স ৭৩৭ বিধ্বস্ত হয়। ২০১৯ সালের মার্চে একই কারণে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের অন্য একটি ম্যাক্স ৭৩৭ বিধ্বস্ত হয়। সফটওয়্যার সংস্কারের কথা জানালেও নীতিনির্ধারকরা এখনো বোয়িংকে সবুজসংকেত দেয়নি।
ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) পরিচালক স্টিভ ডিকসন গত মঙ্গলবার এক শিল্প সম্মেলনে জানান, উড়োজাহাজটি নিরাপদ কিনা, সে বিষয়ে এখনো সব পর্যালোচনা শেষ করেননি তারা। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। বিষয়টি সুরাহা করতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে।
৭৩৭ ম্যাক্স গ্রাউন্ডিং আট মাসে পৌঁছায় গত বৃহস্পতিবার চলতি বছরের জন্য আমেরিকান এয়ারলাইন্স তাদের করপূর্ব আয় পূর্বাভাস ৫৪ কোটি ডলার নির্ধারণ করেছে। গত জুলাইয়ে যেখানে পূর্বাভাস ছিল ৪০ কোটি ডলারের। গ্রাউন্ডিংয়ের ফলে যে শঙ্কা ছিল তা কিছুটা মোকাবিলা করে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আয় করেছে। অবশ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পূর্বাভাসের চেয়ে কিছুটা কমে আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৯১ কোটি ডলারে।