চালক, স্টেশন মাস্টার ও গার্ডের ভুলের কারণে রেলপথে ৭২ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। এই তিন পদে চাহিদার অর্ধেকেরও কম লোকবল দিয়ে ট্রেন চালানোয় চাপ বাড়ছে সংশ্লিষ্টদের ওপর। লোকবলের অভাবে অতিরিক্ত শ্রমে সচল রাখা হয়েছে রেলপথ। তিন পদে কর্মরতরা পরিশ্রমের ধকল সামলে উঠতে না পারায় প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
এ ছাড়া প্রায় ২৩ শতাংশ দুর্ঘটনার নেপথ্যে কারিগরি ত্রুটি এবং অন্যান্য কারণে বাকি ৫ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। জনবলের অভাবে এদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা সম্ভব হয় না। ফলে কাজের ফাঁকে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা মাঠে নামছেন। এসব কারণে নিরাপদ রেল ভ্রমণ ক্রমশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদনে বেশিরভাগ দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনচালক, গার্ড ও স্টেশন মাস্টারকে দায়ী করা হয়েছে। সোমবার গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মন্দবাগ স্টেশনে দুর্ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে ট্রেনের চালক, সহকারী চালক ও গার্ডকে দায়ী করা হয়েছে। অধিকাংশ স্থানের মতো এখানেও চালক ও সহকারী চালক ঘুমিয়ে পড়ায় এ দুর্ঘটনা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান জানান, আখাউড়া মন্দবাগে দুই ট্রেনের সংঘর্ষের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা এসেছে। সব ত্রুটিমুক্ত করে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও দক্ষ করা হবে। তিনি বলেন, প্রায় ৭২ শতাংশ দুর্ঘটনা মানব ভুলে হচ্ছে। চালকের অসতর্কতা, সিগন্যাল অমান্য করা, স্টেশন মাস্টারের দেয়া ভুল সিগন্যাল ও গার্ডের ভুলকেই মূলত হিউম্যান এরর বোঝায়। কারিগরি ত্রুটির মধ্যে রয়েছে রেললাইনে সমস্যা, ইঞ্জিন বিকল, সিগন্যাল কাজ না করা ইত্যাদি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ট্রেনচালক, গার্ড ও স্টেশন মাস্টার। এই তিন পর্যায়ে অনুমোদিত পদের সংখ্যা তিন হাজার ৪৯৩। বর্তমানে কর্মরত আছেন দুই হাজার ২৭৪ জন। তিন পদে লোকবল কম আছে এক হাজার ২১৯ জন। এর মধ্যে চালক পদে ৬৩৯ জন কম। ১৩১ জন গার্ড এবং ৪৪৯ জন স্টেশন মাস্টারের পদ শূন্য।
বর্তমানে কর্মরতরা অতিরিক্ত শ্রম দিয়ে শূন্যপদের কাজগুলো চালিয়ে নিচ্ছেন। অতিরিক্ত শ্রম দিতে গিয়ে তারা আট ঘণ্টা নির্ধারিত সময়ের বিপরীতে গড়ে টানা ১৪-২২ ঘণ্টা কাজ করছেন। আগামী দু’মাসের মধ্যে তিন পদ থেকে শতাধিক লোকবল অবসরে যাবেন। সে ক্ষেত্রে কর্মরতদের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
এদের মধ্যে ট্রেনচালক পর্যায়ে শূন্য পদ সবচেয়ে বেশি। এ পর্যায়ে ৬৩৯টি পদ শূন্য আছে। চালক পদে কাজ করছেন ১ হাজার ১১৮ জন। এদের মধ্যে প্রায় সাতশ’ জন ট্রেন সান্টিংসহ কারিগরি কাজের সঙ্গে জড়িত। বাকি ৪২২ জন চালক ও সহকারী চালক নিয়মিত ট্রেন চালাচ্ছেন।
এরা সারা দেশে ৩ হাজার ১৫৫ কিমি. রেলপথে ৩৮০টি ট্রেন চালাচ্ছেন। এ পরিমাণ ট্রেন চালানোর জন্য প্রায় চার হাজার দক্ষ চালকের প্রয়োজন। সেখানে নিয়মিত কাজ করছেন ৪২২ জন। ফলে প্রত্যেক চালককে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে (৮ ঘণ্টা) কয়েক গুণ বেশি শ্রম দিয়ে ট্রেনের চাকা সচল রাখতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে একজন চালককে গড়ে ২৪-৩৬ ঘণ্টা ট্রেন চালাতে হয় (যাওয়া-আসা)।
এরপর এক দিনের জন্য বিশ্রাম পায়। রেলওয়ে আইন ১৮৯০ অনুযায়ী, কোনো চালক ৮ ঘণ্টা ট্রেন চালালে তাকে, যাত্রা শুরুর আগে ১২ ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হবে। কিন্তু স্বল্পতার কারণে ২৪ ঘণ্টা কাজ করার পরও বিশ্রাম দেয়া সম্ভব হয় না। অতিরিক্ত সময় কাজ করার কারণে ট্রেন চালাতে গিয়ে চালক ঘুমিয়ে পড়ছেন। সিগন্যাল দেখতে ভুল করছেন।
ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। চালকদের বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত স্টেশনে ‘রানিং রুম’ থাকার কথা। আইনানুযায়ী রানিং রুমগুলো আধুনিক হওয়ার কথা। যেখানে তাদেরকে পুষ্টিকর খাবার দেয়া হবে। রান্নার লোক থাকবে। বিনোদন ও খেলাধুলার সুব্যবস্থা থাকবে। বাস্তবে এসবের কিছুই নেই। যেসব স্টেশনে রানিং রুম আছে, তা স্বাধীনতার আগে।
মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ভবনে ভয়-আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হয়। রেলওয়ে ট্রেনচালক ও গার্ড অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, রানিং রুমগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। এসবের কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই। বিশ্রাম নেয়া যায় না, উইপোকা থেকে শুরু করে ইঁদুর, পোকা-মাড়কের বসবাস রুমগুলোতে।
রেলে বর্তমানে ৩৫৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন রয়েছে। এর মধ্যে ৯৮টি আন্তঃনগর। মালবাহী ট্রেন রয়েছে ৩০টি। অর্থাৎ যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন মিলে মোট ৩৮০টি ট্রেন আছে। ট্রেনের গার্ড (পরিচালক) স্বল্পতাও তীব্র। চাহিদা ১ হাজার ৩৫৬ জন, কাজ করছেন চারশ’ জন। চালকের মতো গার্ডকেও অতিরিক্ত শ্রম দিতে হচ্ছে।
চালককে সতর্ক করাসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন একজন গার্ড। রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, গার্ডের দায়িত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ। একটি ট্রেনে ১ জন গার্ড থাকেন। ট্রেনের একেবারে পেছনে ছোট্ট একটি বগিতে (৮ ফুট বাই ১০ ফুট) গার্ড বসেন।
ট্রেনচালক-সহকারী চালক সিগন্যাল ভুল করলেও গার্ড ইচ্ছে করলেই ট্রেন দাঁড় করাতে পারেন। কিন্তু, বাস্তবে গার্ড তা করেন না। চালককের মতো গার্ডও ক্লান্ত থাকায় অনেক সময় চলন্ত ট্রেনের নিজ কামরায় ঘুমিয়ে পড়েন। ফলে রাতের পালায় ঘুমন্ত চালক ও গার্ডের নিয়ন্ত্রণে চলতে থাকে গতিদানব ট্রেন। এ ধরনের ক্ষেত্রেই অধিকাংশ সময় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র গার্ড জানান, চালকদের মতো তাদেরও অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়।
এতে ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, গোসল ঠিক থাকে না। কাজেই ভুল হতেই পারে। এমন অবস্থায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ৪৪ জন অবসরপ্রাপ্ত গার্ডকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত এক গার্ড বলেন, ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো হলে তারাও চুক্তি ভঙ্গ করে কাজ বন্ধ করে দেবেন। কারণ, তাদের বয়স হয়েছে। এ বয়সে শুধু ঊর্ধ্বতনের অনুরোধের ভিত্তিতেই তারা কাজটুকু করতে চাচ্ছেন।
রেলে মোট ৪৪৬টি স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ৩৫৪টি চালু আছে। বাকি ১১২টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। স্টেশন মাস্টার স্বল্পতা দিন দিন চরমে উঠছে। যেখানে ১ হাজার ২০৫ জন স্টেশন মাস্টার থাকার কথা। বর্তমানে আছে ৭৫৬ জন। শূন্যপদ রয়েছে ৪৪৯টি।
রেলপথ বিভাগের অপারেশন বিভাগ থেকে জানা যায়, স্টেশন মাস্টারের জন্য এখনও ১১২টি স্টেশন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। বন্ধ স্টেশনের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। বন্ধ স্টেশনগুলোর প্রতিটির দু’পাশেই সিগন্যাল পয়েন্ট রয়েছে। এসব স্টেশনে লোকবল না থাকায় খুব ধীরগতিতে ট্রেন চালাতে হয়। তাছাড়া পয়েন্টে পাথর কিংবা কোনো শক্ত কিছুর টুকরো ভেতরে থাকলে চরম ঝুঁকি নিয়ে ওই সব স্থান পার হতে হয়।
প্রতিটিতে স্টেশন মাস্টার ও সহকারী স্টেশন মাস্টার বাধ্যতামূলক থাকতে হয়। কিন্তু, চলমান স্টেশনগুলোতে লোকস্বল্পতার কারণে প্রায়ই একজন করে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে রাতের বেলায় দায়িত্বরত স্টেশন মাস্টার প্রায় ঘুমিয়ে পড়েন কিংবা ক্লান্ত হয়ে ঝিমুতে থাকেন।
এ বিষয়ে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়াজাহান যুগান্তরকে জানান, চালক-গার্ডের সঙ্গে স্টেশন মাস্টার স্বল্পতা চরমে উঠেছে। আমরা বাধ্য হয়েই তাদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করাচ্ছি। নতুবা ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। এখনও ১১২টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। আমরা অচিরেই চুক্তিভিত্তিক অবসরপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টারদের নিয়োগ দেব। একই অবস্থা ট্রেনচালক ও গার্ডদের বেলায়ও। পরিবহন বিভাগ থেকে জানা যায়, পূর্বাঞ্চলে ৩৬টি এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৭৬টি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। ট্রেনচালক, গার্ড ও স্টেশন মাস্টার স্বল্পতার সঙ্গে রেলে চলমান ট্রেনের অবস্থাও নড়বড়ে। মোট ২৬৮টি লোকোমোটিভের মধ্যে ১৯৭টি লোকোমোটিভ আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ। একই সঙ্গে ৩ হাজার ৪৮৬টি ওয়াগনের মধ্যে ১ হাজার ২৩৩টি ওয়াগন আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ।
রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, রেলে যখন দিন দিন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তখন এমন দুর্ঘটনা খুবই দুঃখজনক। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়েছি। ইতিমধ্যে সে অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। ভারত ও চীনের চালক, গার্ড, স্টেশন মাস্টারদের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের সঙ্গে আমরা চুক্তি করব। আমাদের চালক-গার্ড ও স্টেশন মাস্টারসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে। একই সঙ্গে দেশেও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। ইতিমধ্যে এ কাজটি শুরু হয়েছে। তাছাড়া এ তিন পর্যায়ে শূন্যপদগুলোর বিপরীতে নিয়োগ খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা এসব নিয়োগ দেয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। গার্ড ও চালকদের জন্য রানিং রুম আধুনিক করা হবে। তাদের জন্য বিনোদনসহ খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হবে।