ইসলাম ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে বিশ্বের কাছে পবিত্র এই ধর্মটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, যারা সত্যিকারের ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন তারা কখনো দ্বন্দ্বে জড়াতে পারেন না। সকলকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সুযোগ দিতে হবে। অন্য ধর্মাবলাম্বীরা যেন আঘাত না পায়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আজ বুধবার বিকেলে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ কথা বলেন।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে এ সংক্রান্ত সম্পূরক প্রশ্নটি উত্থাপন করেন তরিকত ফেডারেশনের সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। জবাবে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ইমলাম শান্তির ধর্ম, বিশ্বের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলাম ধর্মের মধ্যে ভাগ, কে ভাল কে খারাপ, কে প্রকৃত ইসলামে বিশ্বাসী, কে বিশ্বাসী নয়, কে সঠিভাবে ধর্ম পালন করে কে করে না, কে বেহেশেতে যাবে কে যাবে না- তার বিচার তো আল্লাহই করবেন? তার বান্দারা কেন এই বিচার করবেন? কে ভাল মুসলমান, কে মুসলমান নয়- তার বিচার করার ভার আল্লাহ তো কারো হাতে দেননি।
তিনি বলেন, কারো ধর্মে আঘাত দিয়ে কথা বলা, অন্য ধর্মবলাম্বীদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করা যাবে না। যার ধর্ম সেই পালন করবে। সেই বিশ্বাস যদি থাকে তাহলে এ দ্বন্দ্ব আর থাকে না।
সরকারি দলের সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদক- এই তিনটির বিরুদ্ধেই সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিশেষ করে মাদক ব্যবসা, পাচার, সেবন ও বিস্তারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের ফলে মাদক অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মাদক প্রতিরোধের ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তবে সেই সঙ্গে মাদকের কুফল বিষয়ে ছেলে-মেয়েদেরও সচেতন করতে হবে। বাবা-মা, অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও নিজেদের ছেলে-মেয়েদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের পদক্ষেপের ফলে মাদকের বিস্তার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এখানে সমস্যাটা হচ্ছে, একটাকে প্রতিরোধ করা হলে আরেকটা চলে আসে। সরকার এর বিস্তার রোধেও পদক্ষেপ নিচ্ছে। পাশাপাশি তরুণ সমাজ ও আশপাশে যারা আছেন- তাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সমাজকেও আরও সচেতন হতে হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোতে সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলে আইন প্রণয়ন করার দাবি জানিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকালীন কোর্স বাতিলের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি নিজেই কথা বলেছেন। তবে এ নিয়ে কোনো আইন করার প্রয়োজন নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদালয় মঞ্জুরি কমিশনই (ইউজিসি) এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। এর পরও সরকার দেখবে এ বিষয়ে কী করা যায়।
বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে তার সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে বলেন, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য চাকরিতে আলাদা কোটা কেন রাখতে হবে? এটা রাখার কোনো প্রয়োজন নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের পদক্ষেপের ফলে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তরুণরা যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্বকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং নিজেরা স্বউপার্জিত হয়ে অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন- সেজন্যও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর পরও এদেশের ছেলে-মেয়েদের প্রবণতা রয়েছে, যেভাবেই হোক লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করতেই হবে। বিদেশে কিন্তু এই প্রবণতা নেই। এই মানসিকতা বদলে ছেলে-মেয়েরা যদি নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন, শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে পারেন- তাহলে তারা অন্যদেরও চাকরি দিতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, এদেশে ১৬ কোটি মানুষ রয়েছে। এই বিশাল জনসংখ্যা থেকে যদি কেউ কেউ বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যান-সেটা দেশের জন্যই ভালো হয়। পৃথিবীটা এখন আর কোনো দেশে সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীটাই এখন একটা গ্লোবাল ভিলেজ।
তিনি বলেন, প্রশ্ন উত্থাপনকারী সংসদ সদস্যের দলের (বিএনপি) আমলে শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র ও মাদক তুলে দিয়ে তাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি ও বোমাবাজির মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনগুলোকে অশান্ত করে তোলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই পরিবেশটা এখন আর নেই।
সরকার দলীয় সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম। কোরআন ও হাদিসের আলাকে তা তরুণ শিক্ষার্থীদের বুঝাতে দেশের আলেম সমাজ সক্রিয় সহযোগিতা করছেন।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের টেকসই করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করছি।
একই প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস যেমন- ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এবং ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে শিশু-কিশোরদের অবহিত করার জন্য পাঠ্যপুস্তকে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার নির্মাণ করা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা মুক্তিচিন্তা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে বেড়ে উঠুক সে প্রত্যাশায় বাংলাদেশ রিসার্চ এ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে বহির্বিশ্বের গবেষণা ও শিক্ষা নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা জানান, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেন সম্পৃক্ত না থাকে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ চালু হওয়ার ফলে অন্যান্য অপরাধের মতো জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় জঙ্গিবাদ দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরকার দলীয় সদস্য এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি গ্রামে আধুনিক শহরের সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য সরকার নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ জন্য গ্রামীণ সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়েকে জনগণের কাছে নির্ভরযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহণ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।