ইসলাম আত্মপ্রকাশ করার পর মক্কার মুসলিমদের ভেতর নিজস্ব অর্থনৈতিক চিন্তার বিকাশ ঘটতে থাকে। তবে মক্কার নানামুখী সংকট সে চিন্তাকে ‘নিজ সম্প্রদায়ে’র মুক্তি চিন্তায় আবদ্ধ রাখে। মক্কার সামর্থ্যবান মুসলিমরা কুরাইশদের অত্যাচার ও অবিচার থেকে দরিদ্র মুসলিমদের রক্ষা করতে একক ও সম্মিলিত একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। খাদিজা (রা.)-কে বিয়ে করার পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে যে সম্পদ তুলে দেওয়া হয়, তাও তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণে ব্যয় করেন। আল্লাহর নির্দেশেই এই কল্যাণকামী অর্থনীতির বিকাশ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ১৯)
মক্কায় অবতীর্ণ অপর একটি আয়াতেও কল্যাণ অর্থনীতির নির্দেশনা পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের সম্পদ বাড়াতে তোমরা যে সুদ দিয়ে থাকো আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে না। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে জাকাত তোমরা দাও তা-ই বৃদ্ধি পায়; আর তারাই সমৃদ্ধিশালী।’ (সুরা : রোম, আয়াত : ৩৯)
মদিনায় অর্থ প্রশাসনের যাত্রা
হিজরতের পর মদিনায় ইসলামী অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। এই সময় স্বতন্ত্র অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলে মহানবী (সা.) নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল স্বতন্ত্র মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, ‘এটি তোমাদের বাজার। এখানে কেউ তোমাদের ওপর করারোপ করবে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২/৭৫১)
হিজরতের পর স্বতন্ত্র ইসলামী অর্থব্যবস্থা আত্মপ্রকাশ করলে মহানবী (সা.) রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন, বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়, উৎপাদন, বাজারব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অর্থের প্রবাহকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করা। মানুষের ক্ষতিকর প্রবণতা রোধ করে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
নবীযুগের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও পরিভাষা
মহানবী (সা.)-এর যুগে ইসলামী অর্থনীতির বেশ কিছু মৌলিক কার্যক্রম ও পরিভাষা গড়ে ওঠে, যা পরবর্তী সময়ে বিকশিত ইসলামী অর্থনীতির মূলভিত্তি। নিম্নে এমন কয়েকটি আর্থিক কার্যক্রম ও পরিভাষা তুলে ধরা হলো।
জাকাত : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে গড়ে ওঠা সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছিল জাকাত ব্যবস্থাপনা। জাকাত অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, প্রাচুর্য ও পবিত্রতা। পরিভাষায় জাকাত হলো, ধনীর সম্পদ থেকে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দরিদ্র মুসলিমকে দান করা। সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে জাকাত প্রদান করা ফরজ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করুন। এর দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করবেন, পরিশোধিত করবেন। আপনি তাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনার দোয়া তাদের মনে প্রশান্তি আনবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) কোন কোন সম্পদের ওপর জাকাত হবে, তার হার কত হবে এবং কোন কোন বিষয় লক্ষ রেখে জাকাত সংগ্রহ করা হবে তা ঠিক করে দেন। জাকাত সংগ্রহের জন্য কর্মীও নিয়োগ দিয়েছিলেন মহানবী (সা.)। আদায় করা সম্পদ নিয়মমাফিক মদিনার অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন। জাকাত ব্যবস্থাপনাকে স্বনির্ভর ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে জাকাতের অর্থ থেকে তার কর্মীদের বেতন অনুমোদন করেন। তিনি বলেন, ‘জাকাতের কর্মীদের অধিকার যুদ্ধফেরত গাজিদের মতোই।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩/৪৬৫)
জাকাত সংগ্রহের জন্য মহানবী (সা.) যাঁদের নিয়োগ দেন তাঁদের কয়েকজন হলেন মুহাজির ইবনে আবি উমাইয়া (রা.)-কে সানায়, জিয়াদ ইবনে লাবিদ আনসারি (রা.)-কে হাদারামাউতে, আদি ইবনে হাতিম (রা.)-কে তাইয়ি গোত্রের কাছে, আমর ইবনুল আস (রা.)-কে আম্মানে, খালিদ ইবনে সাঈদকে মুরাদে, আলী ইবনে আবি তালেব ও আমর ইবনুল হাজম (রা.)-কে নাজরানে এবং মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন গোত্রের কাছে বিভিন্ন সময়ে একাধিক সাহাবিকে প্রেরণ করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ২/৬০০; তাবাকাতে ইবনে সাদ : ১/৩২২)
গনিমত : গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মহানবী (সা.)-এর অর্থ প্রশাসনের অন্যতম প্রধান কার্যক্রম ছিল। মদিনা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসব সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। সমকালীন যুদ্ধনীতির আলোকে ন্যায়সংগতভাবেই এই সম্পদ সংগ্রহ করা হতো এবং মহানবী (সা.) ওহির নির্দেশনা অনুযায়ী তা নিজেই বণ্টন করতেন। কোরআনে গনিমতের সম্পদে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য ‘এক-পঞ্চমাংশ’ নির্ধারিত হওয়ার আগে পুরোটা সাহাবিদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। আর এক-পঞ্চমাংশ নির্ধারিত হওয়ার পর তা রেখে
অবশিষ্ট অংশ সাহাবিদের মধ্যে বণ্টন করা হতো। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা ছাড়া নারী, শিশু ও দাসরা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশ পেত।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গনিমত অর্জন করে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাস (রা.)-এর টহল দল। নাখলার নিকটবর্তী স্থানে একটি কুরাইশ দলকে আটক করে তারা এই সম্পদ অর্জন করেন। মহানবী (সা.)-এর যুগের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গনিমত হলো বদর, বনি নাজির, আহজাব, খায়বার ও হুনাইন। (আল্লামা ওয়াকেদি, আল মাগাজি : ১/১৮; সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৬০৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গনিমতের সম্পদ বণ্টিত হলেও এখানেও প্রাতিষ্ঠানিকতা ছিল। বিভিন্ন যুদ্ধে গনিমত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বণ্টনের কাজে কর্মী নিয়োগ দিতেন মহানবী (সা.)। তাদের ‘সাহিবুল গানায়িম’ বলা হতো। বদর যুদ্ধে আবদুল্লাহ বিন কাব (রা.) বণ্টনের আগের কাজগুলোর জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় এবং মুহাইয়ামা বিন জুস (রা.)-কে তা বণ্টনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। (তারিখে ইয়াকুবি : ২/৭৬)
জিজিয়া : ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকরা যে নিরাপত্তা কর প্রদান করে তাকে জিজিয়া বলা হয়। মুসলিম শাসক যদি অমুসলিমদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে জিজিয়া ফেরত দেওয়ার বিধান রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে জিজিয়া রাষ্ট্রের অন্যতম আয়ের উৎস ছিল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে এই অর্থ ব্যয় করা হতো। মহানবী (সা.)-এর যুগে কয়েকটি অঞ্চল ইসলামী রাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করেছিল।
তন্মধ্যে রোম, আজরাহ, জারবা, তুবালা, জার্শ, নাজরান, ইয়েমেন ও বাহরাইন অন্যতম। নবম হিজরিতে সুরা তাওবার ২৯ নম্বর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর জিজিয়ার বিধান প্রবর্তিত হয়। তবে নাজরান বা হিজর কোন অঞ্চলের অধিবাসীর ওপর প্রথম জিজিয়া আরোপ করা হয় তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। (ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.), কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ১২৯; আল্লামা ওয়াকেদি, আল মাগাজি : ৩/৯৯০-৯৯২)
উপরোল্লিখিত জাকাতের কর্মীরা নিজ নিজ অঞ্চলের জিজিয়া আদায়ের ব্যাপারেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন।
অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লিখিত তিনটি প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও উশর (মুসলিমদের ভূমিকর), খারাজ (অমুসলিমদের ভূমিকর), ফাই (বিনা যুদ্ধে অর্জিত রাষ্ট্রীয় সম্পদ), ওয়াক্ফ (কল্যাণকর কাজে দান করা স্থাবর সম্পদ), দারবা (যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে নগদ দান) ইত্যাদি ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অর্থ প্রশাসনের অন্যতম কর্মকাণ্ড।