কবরের ওপর হাত বুলিয়ে কী যেন খুঁজছিলেন তিনি। বারবার চোখ মুছছিলেন আর কবরের ওপর পড়ে থাকা ঝরা পাতা সরাচ্ছিলেন। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছিল কবরের ওপর। গতকাল বৃহস্পতিবার এমন আবেগঘন দৃশ্য দেখা যায় আজিমপুর কবরস্থানে।
কবরটি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত রেহনুমা তারান্নুম দোলার। যিনি হাত বোলাতে বোলাতে কাঁদছিলেন তিনি দোলার বাবা দলিলুর রহমান দুলাল। তিনি বলছিলেন, ‘মেয়েটাকে এক বছর ছুঁয়ে দেখতে পারি না। কোনো আবদারও করে না। কবরে হাত বুলিয়ে তার ছোঁয়া পেতে চেষ্টা করছিলাম। জানি কোনো লাভ নেই! তবু আসি তার শান্তি কামনায়।’
গতকাল চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর পূর্ণ হয়েছে। গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টা মোড়ের ওয়াহিদ ম্যানশন নামের একটি ভবনের আগুনে পুড়ে নিহত হন ৭১ জন। তাদের মধ্যে ১১ জনকে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে।
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর উপলক্ষে গতকাল সকাল ৯টায় ‘ঐক্যবদ্ধ সামাজিক সংগঠন’ ব্যানারে ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে দোয়ার আয়োজন করা হয়। একই সঙ্গে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কালো ব্যাজ ধারণ ও গণস্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়।
প্রিয়জনকে হারিয়ে দিশাহারা পরিবারগুলোর সদস্যরা এখনো স্মৃতি হাতড়ে ফিরছেন। পরিবারগুলোর অভিযোগ, গত এক বছরেও সরকারি-বেসরকারি কোনো ধরনের সহায়তা পায়নি তারা। ওয়াহিদ ম্যানশনে ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
অবশ্য গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ক্ষতিগ্রস্ত ৩১ পরিবারের সদস্যদের চাকরি, দোকান বরাদ্দ ও নগদ সহায়তা হস্তান্তর করে।
সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, নিহতদের পরিবারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন জড়ো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সদস্যদের কান্না ও আহাজারিতে সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। চুড়িহাট্টা একতা সংঘ, প্রতিদান ফাউন্ডেশন, সোনাইমুড়ী থানা মানব কল্যাণ ফাউন্ডেশন, মানবতার ডাক, হিউম্যান হেলপফুল অর্গানাইজেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে এবং নিহতদের স্মরণ করে গণস্বাক্ষর করেন পথচারী ও স্থানীয় লোকজন। সেই সঙ্গে সবাইকে পরিয়ে দেওয়া হয় কালো ব্যাজ। নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে কোরআন খতম ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে গণস্বাক্ষরে অনেকেই লিখতে দেখা যায়, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি,’ ‘দোষীদের শনাক্তের দাবি’, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো সরকারের দায়িত্ব’, ‘কেমিক্যাল নামের মৃত্যু’। আবার কেউ বা লিখেছেন, ‘পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন চাই না।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি হাফেজ হারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের এক বছর হয়ে গেল। আমরা ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে দাঁড়িয়েছি, কথা বলছি। এর আগেও দাঁড়িয়েছিলাম; কিন্তু নিহত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কোনো সুবিধা পায়নি। নিহত অনেকের স্বজনরা এখনো চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন; কিন্তু চাকরি পাচ্ছেন না। সরকারের কাছে তাঁদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা করার আকুল আবেদন জানাচ্ছি।’
সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় দোকানিরা ব্যস্ত ছিলেন বেচাকেনায়, দূর থেকে আসা ব্যবসায়ী আর ক্রেতাদের ছিল ফেরার তাড়া। রাস্তায় ছিল পথচারী আর চলতি পথের যাত্রীদের ভিড়। গতকাল সেই স্থানে স্বামী ও সন্তানের ছবি হাতে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী অঝোরে চোখের পানি ফেলছিলেন।
চুড়িহাট্টা শাহি মসজিদ মার্কেটের নিচতলায় গামছা-তোয়ালে-তসবিহসহ বিভিন্ন জিনিসের দোকান ছিল পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীদের। মাঝেমধ্যেই বাসা থেকে এসে বাবা-চাচাদের সঙ্গে সময় কাটাত ছোট্ট আরাফাত। রাত সাড়ে ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নেওয়ার মধ্যেই ঘটে সেই বিস্ফোরণ। কিছুক্ষণ আগে দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান আলী-অপুদের আরেক ভাই দীপু হোসেন। দীপু বলেন, ‘কেন যে সবাইকে নিয়া আগে আগে চইলা গেলাম না! যদি জানতাম তাগোরে না নিয়া জীবনেও যাইতাম না।’
আজিমপুর কবরস্থানে স্বজনদের কান্না : আজিমপুর কবরস্থানে যাঁদের দাফন করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হাজি মো. ইসমাইল, মো. ইব্রাহীম, রেহনুমা তারান্নুম দোলা, ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি, মোহাম্মদ আলী, আরাফাত, জয়নাল আবেদীন বাবুল, ইয়াসিন খান রনি, জুম্মন, আবতাহী-বিন-সালেহ।
গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, বাবা জুম্মনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কান্না করছেন ছেলে রাশেদ খান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার বাবা ব্যবসা করতেন সেদিন যে দুর্ঘটনা ঘটেছে এর ক্ষতি কখনো ফুরাবে না। বাবার জন্য দোয়া করতে এলাম। প্রায় দিনই আসি। সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ, আমাদের দিকে একটু তাকান।’