যে লোক নিজের দেশকে ধর্মের নামে ভাগ করে ক্ষমতায় থাকতে চায়- তার মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতেও লজ্জা লাগবে আমাদের, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার লাগবে না?
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে- এটা পুরনো খবর। শুরু থেকেই ব্যাপারটা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল। এই মুহূর্তে দিল্লি জ্বলছে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে, মোদি তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তার স্ত্রীর সেবায় মগ্ন। রোম পোড়ার সময়টায় নিরো বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, নরেন্দ্র মোদি আর নিরোর মধ্যে এই জায়গায় তফাৎ নেই খুব একটা। এর আগেও গুজরাট দাঙ্গা হয়েছে মোদির আমলে, ঝরে গেছে হাজারের বেশি প্রাণ, সেসবের দায় মোদি এড়িয়ে যেতে পারেন না কোনভাবেই। সেই লোকটাকেই কীনা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ডেকে আনা হচ্ছে সম্মান করে? এতে যে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে অপমান করা হচ্ছে, সেটা কি আমাদের সরকারের মাথায় আছে?
বঙ্গবন্ধু একটা অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে বাংলাদেশে সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে কোন ধর্মের মানুষকে নির্যাতিত হতে হবে না। সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্যে সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি জেল খেটেছেন, শত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের নামের আগে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অফ’ লাগানোর কথা বলেছিলেন সৌদি বাদশাহ, বঙ্গবন্ধু তখন মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলেন।
দেশ কখনও ধর্মের মুখাপেক্ষী হতে পারে না- এমনটাই মনে করতেন শেখ মুজিবুর রহমান নামের মানুষটা। পাকিস্তানীরা এজন্যে তাকে হিন্দুদের চর আখ্যা দিয়েছিল, অথচ তিনি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক একজন নেতা। তিনি হিন্দুর নেতা ছিলেন, মুসলমানের নেতা ছিলেন, ছিলেন বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার নেতা। ধর্মের মেরুকরণ করতে চাইলে বঙ্গবন্ধু অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষেই থাকতেন, বাঙালীর স্বাধীকারের সপক্ষে আন্দোলন করতেন না।
অথচ সেই মানুষটার জন্মের একশো বছর পালন করার জন্যে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমরা ডেকে আনছি কাকে? নরেন্দ্র মোদিকে, যিনি কিনা আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িকতায় পরিপূর্ণ এক নেতা। ধর্মের বিভাজন টেনেই তার দল রাজনীতি করে, বিজেপির পলিটিক্যাল এজেন্ডাই এটা- হিন্দু মুসলমানে দেশকে ভাগ করো, হিন্দু ভোট ব্যাংককে কাছে ডাকো, হিন্দু ধর্ম বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে, এমন একটা ভীতির সঞ্চার করো! সেটা করেই ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি, ধরে রেখেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
গুজরাট দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার কথা এখনও ভুলতে পারে না সেখানকার মুসলমানেরা। সরকারী হিসেব অনুযায়ীই ৭৯০ জন মুসলমান নিহত হয়েছিলেন সেই দাঙ্গায়, প্রাণ হারিয়েছিল আড়াইশোর বেশি হিন্দুও। বেসরকারী হিসেবে সংখ্যাটা কয়েকগুণ। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, কয়েক হাজার মানুষ এখনও নিখোঁজ, যদিও মোদির গুজরাট সরকার বলে দিয়েছিল যে সেই নিখোঁজ লোকগুলো ভয়ে পাকিস্তানে চলে গেছে। তাদের ভাগ্যে কি নির্মম পরিণতি ঘটেছিল, সেটা আজও জানে না কেউ। সেই দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ না করে তিন মাস ধরে চলতে দিয়েছিল গুজরাট সরকার, যে সরকারের প্রধাণ ব্যাক্তি ছিলেন এই নরেন্দ্র মোদি।
এখন দিল্লি জ্বলছে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে, পঁচিশজন ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন দাঙ্গায়। মুসলমানদের দোকানপাট আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হচ্ছে, পুড়ছে ঘর, পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে মানুষকে। মসজিদ ভাঙচুর হয়েছে, মিনারে চড়ানো হয়েছে হিন্দুত্বের প্রতীক গেরুয়া পতাকা, পোড়ানো হয়েছে কোরআন শরীফ। বাচ্চাদের জন্যে খাবার কিনে ঘরে ফিরতে পারেননি বাবা, ফিরেছে তার লাশ। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ কনস্টেবল মরেছেন গুলি খেয়ে, কোথাও আবার পুলিশকেই দেখা গেছে দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে একজোট হয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানের ওপর হামলা চালাতে, তাদের দোকানে লুটপাট করতে। দিল্লি পুলিশ মোটামুটি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই নিস্কর্মার পরিচয় দিয়েছে, বজায় রেখেছে মোদি সরকারের পা চাটার ধারাবাহিকতা।
আর নরেন্দ্র মোদি, দ্য সুপ্রীম লিডার অফ ইন্ডিয়া- তিনি কি করছেন এই সময়ে? ভারত সফরে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তার স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্পের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। তাদেরকে স্টেডিয়ামে নিয়ে যাচ্ছেন, ভুলভাল ইংরেজীতে ভাষণ দিয়ে লোক হাসাচ্ছেন। তার দেশের রাজধানীতে আগুন জ্বলছে, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে দিল্লি- আর মোদি কিনা তিনদিন পর একটা টুইট করেই নিজের দায়িত্ব খালাস করেছেন!
মোদি-অমিত শাহদের রাজনীতিই এটা, ধর্মীয় বিভাজন। মানুষকে বিভক্ত করে নিজেদের ভোটব্যাংকের সমীকরণ ঠিক রাখা। সেটাই তারা করছেন, তাতে মানুষ মরলে মরুক, আগুন জ্বললে জ্বলুক, দেশ পুড়ে ছারখার হলে হোক- মোদির কী আসে যায়? কিন্ত আমাদের সরকারকে ভাবতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভাবতে হবে, নিজের বাবার জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি কি এমন একজনকে প্রধান অতিথি হিসেবে নিয়ে আসবেন, যার হাতে দাঙ্গায় নিহত হাজারো মানুষের রক্ত লেগে থাকার অভিযোগ আছে? যে লোক নিজের দেশকে ধর্মের নামে ভাগ করে ক্ষমতায় থাকতে চায়- তার মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতেও লজ্জা লাগবে আমাদের, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার লাগবে না?