বাজেট মানেই রাজস্ব আদায়ের টার্গেট। সরকার প্রতিবছরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের টার্গেট বেঁধে দেয়। এবং এই টার্গেট প্রতিবছরই বাড়ে। কিন্তু শেষমেষ সরকারের বেঁধে দেওয়া সেই লক্ষ্যমাত্রা এনবিআরের পক্ষে শতভাগ পূরণ করা সম্ভব হয় না।
দেখা যায়, অর্থবছরের মাঝামাঝিতে এসে প্রতিবারই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কাটছাট করে কমিয়ে আনা হয়। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কাটছাট করে সংশোধনী আনা হয়েছে।
তবে করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা সম্ভব হবে না। চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে রাজস্ব আদায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কম হবে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম অর্থ সচিবকে পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছেন, করোনা মহামারির কারণে রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব হবে না।
চলতি অর্থবছরের জন্য এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। এদিকে অর্থ সচিবকে পাঠানো চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ হতে বড় জোর ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে এনবিআরের রাজস্ব আদায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কম হবে। আর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে আদায় কমবে ৮০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এনবিআর রাজস্ব সংগ্রহ করে মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর ও শুল্ক- এই তিনটি খাত থেকে। এর মধ্যে মূসক থেকে ৯৭ হাজার ৫৯ কোটি, আয়কর থেকে ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে ৭৩ হাজার ১৯২ কোটি টাকা আসতে পারে বলে চিঠিতে জানানো হয়েছে।
চিঠিতে এনবিআর চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসজনিত মহামারি পৃথিবীর সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বিশেষত এ দুর্যোগ পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে এবং কবে আগের জীবনযাত্রা ফিরে আসবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। কর আহরণ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সারাবিশ্বের সব মানুষের ভোগ, চাহিদার ওপর নির্ভরশীল।
চিঠিতে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ জনিত পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সনাতনী ধারায় অর্থনীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আহরণ, বণ্টন, বাণিজ্য ও ভোগে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসবে এবং সারাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশেও পরিবর্তনের ঢেউ আঘাত হানবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় ভোগের চাহিদা কমে গেলে আমদানি কমবে, শিল্প-উৎপাদন কমলে কাঁচামাল-যন্ত্রপাতির চাহিদা কমে যাবে। এতে পরোক্ষ করের ওপর ব্যাপক ঋণাত্মক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে আয়বর্ধক কার্যক্রম কমে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে প্রত্যক্ষ করও কমে আসবে।
ধারণা করা হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বড় একটি অংশ জনগণের মৌলিক চাহিদার সেবায় নিয়োজিত হবে। যার মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, খাদ্য, শিক্ষা, আবাসন ও জনগণের নিরাপত্তার দিকেই অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। এসব মৌলিক সম্পদ, উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ ও সেবার বেশিরভাগই সম্পূর্ণ করমুক্ত বা ন্যূনতম করের আওতাধীন। তাই নিকট ভবিষ্যতে দুর্যোগ অবস্থা স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও তার দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়ায় রাজস্ব আদায় ব্যাপকভাবে কমে যাবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান চিঠিতে আরও বলেছেন, অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলে মাঠ পর্যায়ে রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তাদের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। অনেকে অসম্ভব বিবেচনা করে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয় এবং অনেক ক্ষেত্রে করদাতাদের ওপর হয়রানির অভিযোগ আসে।
এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এনবিআরের পক্ষ থেকে অর্থ সচিবকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে সবকিছু বলা আছে। সেটাই আমাদের বক্তব্য। এর বাইরে কিছু বলার নেই।’
অপরদিকে রাজস্ব আহরণের বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘এনবিআর চেয়ারম্যান যেটা বলেছেন সেটা বাস্তব কথা। করোনার তিনমাস কোনো রাজস্ব আদায় হয়নি। বর্তমান যে টার্গেট আছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সেটা পূরণ হবে না। স্বাভাবিক একটি দুর্যোগ আসলে এমন হয়। চিঠি লিখে কোনো লাভ নেই। সরকার যে বাজেট তৈরি করে সেটা নিয়েই এনবিআরকে কাজ করতে হয়। সরকার ধরে নিয়েছে, আগামী ২ থেকে ৪ মাসের মধ্যে করোনা চলে যাবে। তাহলে আবার দেশের অবস্থা ভালো হবে। সেই হিসেবে বড় লক্ষ্যমাত্রা আগামী বাজেটেও আসছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চেষ্টা করে যেতে হবে রাজস্ব আহরণে। আর সেটা যতটা পারে। আগে বাজেট হতো রাজস্ব কী পরিমাণ আদায় হবে সেটার ওপর। এখন বাজেট তৈরিতে পরিবর্তন এসেছে। বাজেট নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ অবশ্যই আছে। আগামী যে বাজেট আসছে সেখানে যদি কোনোভাবে রাজস্ব আহরণ পূরণ করা যায় তাহলে সেটা হবে এনবিআরের জন্য বড় অর্জন।’
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে রাজস্ব আহরণ কমবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর সেটাই হয়েছে। এরপরও এনবিআরকে কাজ করে যেতে হবে। ভালো কিছু করতে হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। তবে সবাইকে চেষ্টা করে যেতে হবে। আমি আশাবাদী সবকিছু ঠিক হলে রাজস্ব আহরণ আবারও বাড়বে।’