করোনাভাইরাসে ব্যাংককর্মীদের আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় ব্যাংকগুলো কর্মীদের পালাক্রমে কাজ করার সুযোগ দিলেও সংক্রমণ রোধ করা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত সহস্রাধিক ব্যাংককর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন অন্তত ২৫ জন। এত দিন শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তারা বেশি আক্রান্ত হলেও বর্তমানে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আক্রান্ত হচ্ছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংকের চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমী ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান মো. সেলিম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

জানতে চাইলে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে ব্যাংকাররাও কাজ করছেন জীবন বাজি রেখে। আমাদের প্রায় ২৬৫ জন সম্মুখযোদ্ধা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, আমরা চেষ্টা করছি তাঁদের মনোবল ঠিক রাখতে। কর্মীদের মনোবল ঠিক না রাখলে, কাজ না করলে সামনে আগানো যাবে না। এ জন্য কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিশেষ প্রণোদনা ভাতা কর্মীদের দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’

করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে সাধারণ ছুটির মধ্যেও সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবা চালু রাখা হয়। করোনার মধ্যে কর্মীদের অফিসে যেতে উৎসাহ বাড়াতে চালু করা হয় বিশেষ প্রণোদনা ভাতা ও বীমা সুবিধা। তবে সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার দিন থেকে বিশেষ প্রণোদনা ভাতা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে চলতি মাস থেকে কয়েকটি ব্যাংক তাদের কর্মীদের বেতন কমানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা জুলাই মাস থেকে কার্যকর হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণ ছুটি শেষে গত ৩১ মে থেকে পুরোদমে ব্যাংকিং লেনদেন চালু হওয়ায় এখন কর্মীদের সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বেড়েছে। কারণ লেনদেনের পরিধি বাড়ায় ব্যাংকে গ্রাহক উপস্থিতিও বেড়েছে। গণপরিবহন চালু হওয়ায় রাস্তাঘাটে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। ফলে অফিসে যাওয়া-আসা এবং পূর্ণ ব্যাংকিং লেনদেনের সময় ব্যাংককর্মীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। মূলত করোনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকা, ব্যাংকের শাখায় স্থান সংকট ও গ্রাহকদের অসচেতনতার কারণে ব্যাংকিং লেনদেনে সামাজিক দূরত্ব যথাযথভাবে বজায় রাখা যাচ্ছে না। মাস্ক এবং গ্লাভসও ব্যবহার করছেন না অনেকে। এতে গ্রাহকদের পাশাপাশি কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে চলমান সাধারণ ছুটির সময় ব্যাংকে কর্মীদের উপস্থিতি বাড়াতে গত ১২ এপ্রিল বিশেষ প্রণোদনা ভাতা ঘোষণা করে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সার্কুলারে বলা হয়, এ সময়ে ১০ দিন অফিসে গেলে ব্যাংককর্মীরা এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ভাতা পাবেন। এ বিশেষ ভাতার পরিমাণ মাসিক সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা। এরপর ১৫ এপ্রিল আরেক সার্কুলারে সাধারণ ছুটি চলাকালীন আক্রান্ত ব্যাংককর্মীদের জন্য পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে এই সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়। এ সময় করোনায় আক্রান্ত হয়ে কোনো ব্যাংককর্মী মারা গেলে বীমার জন্য নির্ধারিত অঙ্কের পাঁচ গুণ অর্থ তাঁর পরিবারকে দেওয়ার কথাও বলা হয়। সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিন এই স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা কার্যকর থাকবে। তবে সাধারণ ছুটির পর প্রণোদনা ভাতার সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে গত মাসে আরেকটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ২৯ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা চালু থাকার কথা।

বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তা মারা গেছেন। তবে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছয়জন কর্মকর্তা হারিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এ ছাড়া দ্য সিটি ব্যাংকের তিনজন, জনতা ব্যাংকের দুজন, অগ্রণী ব্যাংকের দুজন, রূপালী ব্যাংকের দুজন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের একজন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের দুজন, এনসিসি ব্যাংকের একজন, উত্তরা ব্যাংকের একজন, ন্যাশনাল ব্যাংকের একজন, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের একজন ও এক্সিম ব্যাংকের একজন মারা গেছেন। এর বাইরে করোনার উপসর্গ নিয়ে বেশ কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা মারা গেছেন বলেও জানা গেছে।